সমকালীন প্রতিবেদন : চাইলেই আর জমি কাড়তে পারবে না ওয়াকফ! রাষ্ট্রপতির কলমে আইনে পরিণত হয়েছে বিল। বদলে গেছে ওয়াকফ সম্পত্তি দাবি করা থেকে শুরু করে তা পরিচালনার নিয়ম। কিন্তু ওয়াকফ কি? কী এই সংশোধিত ওয়াকফ বিল? কেনই বা তা নিয়ে এত হইচই? তাহলে কি ওয়াকফ বোর্ডের সব জমি, সম্পত্তি এবার চলে গেল কেন্দ্রের অধীনে?
ওয়াকফ সংশোধনী বিলে ইতিমধ্যেই সই করেছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। ফলে সংসদে পাশ হওয়া বিলটি পরিণত হয়েছে আইনে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী ‘ওয়াকফ’ শব্দের অর্থ ‘ঐক্যবদ্ধ ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা ও উন্নয়ন’। নয়া আইন মোতাবেক, তাই কোনও জমি ওয়াকফ কি না, সেই সম্পর্কিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসক। বোর্ডে এবার থেকে থাকতে পারবেন অমুসলিম প্রতিনিধিরাও। নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারেরও।
আরও বিস্তারিতভাবে জানাবো সংশোধিত ওয়াকফ বিলে কি কি আছে? কিন্তু তার আগে জানা দরকার ওয়াকফ আসলে কি? মুসলিম আইনে যে স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি দলিলের মাধ্যমে আল্লাহর নামে লিখে দেওয়া হয়, তাকেই ওয়াকফ সম্পত্তি বলা হয়। এই সম্পত্তি মূলত সেবামূলক কাজে ব্যবহার করা হয়। এই সম্পত্তি কখনও হস্তান্তর করা যায় না। সাধারণত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবর, মসজিদের জন্য এবং দরিদ্রদের আশ্রয় দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয় ওয়াকফের জমি।
আর যাঁদের কাছে ওয়াকফ সম্পত্তি থাকে, আইনের চোখে তাঁরাই ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য। ১৯৬৪ সালে তৈরি হয় সেন্ট্রাল ওয়াকফ কাউন্সিল। দেশ জুড়ে ওয়াকফ বোর্ডগুলি এই কাউন্সিলের নজরদারিতে চলে। কিন্তু সংশোধিত ওয়াকফ বিলে ওয়াকফ কাউন্সিল যে কোনও জমির অধিকারের দাবি জানাতে পারবে না। বর্তমান ওয়াকফ আইনের ৪০ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যে কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসাবে ঘোষণার অধিকার এত দিন ছিল ওয়াকফ বোর্ডের হাতেই।
অতীতে ওয়াকফ বোর্ডের বিরুদ্ধে বার বার বহু গরিব মুসলিমের সম্পত্তি, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ব্যক্তির সম্পত্তি অধিগ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের সেই একচ্ছত্র অধিকার কেড়ে নিয়ে কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ কি না, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে জেলাশাসক বা সমপদমর্যাদার কোনও আধিকারিকের হাতে। মানে জেলা শাসক পর্যালোচনা করবেন এই দাবির। তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন যে ওই জমির আদৌ মালিক কি না ওয়াকফ। যাতে সম্পত্তির সঠিক মূল্যায়ন হয়।
তাছাড়া এতদিন পর্যন্ত কোনও নথি না থাকলেও, মৌখিকভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিত করা যেত। ওয়াকফের দখল করা জমি বা সম্পত্তিতে কোনওভাবেই পর্যালোচনা করার সুযোগ থাকত না। কারও আপত্তি সত্ত্বেও জমি বা সম্পত্তি দখল করতে পারত ওয়াকফ বোর্ড। তাতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকত না সরকারের। কিন্তু নতুন বিলে তার বন্দোবস্ত রয়েছে। মোদ্দা কথা, এবার থেকে নথি না থাকলে সেই জমি বিতর্কিত বলেই ধরে নেওয়া হবে।
এছাড়া থাকছে একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তিকরণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব। আরেকটা বিষয় এখানে উল্লেখ্য, মূলত সম্পত্তিতে মুসলিম মহিলা ও শিশুদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যই ওয়াকফ আইনে সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রের তরফে। আর নতুন আইন অনুযায়ী, এবার থেকে ওয়াকফ কাউন্সিলে সর্বাধিক ৪ জন অমুসলিম প্রতিনিধি থাকবে। ২ জন মহিলা প্রতিনিধিও থাকবে। মোদ্দা কথা, নতুন আইনে দেশের ওয়াকফ সম্পত্তির ম্যানেজমেন্ট ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা উন্নয়নের চেষ্টা করা হবে বলেই জানানো হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। এতে স্বচ্ছতা আসবে ওয়াকফ সম্পত্তিতে, এমনই ভাবনা কেন্দ্রের।
যদিও, ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরোধিতা প্রসঙ্গে মুসলিম সংগঠনগুলির যুক্তি ছিল, ওয়াকফ বোর্ডের বিভিন্ন সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যেই ওই বিল আনছে কেন্দ্র। তবে কেন্দ্রের যুক্তি, খোদ মুসলিম সমাজের গরিব এবং মহিলারাই নাকি এত দিন ওয়াকফ আইন সংস্কারের দাবি জানাচ্ছিলেন। তার পরেও থামেনি সমালোচনা। এমনকি আটকে থাকে নি বিল থেকে আইনে পরিণত হওয়াও। বিরোধীদের প্রবল আপত্তি ও হট্টগোলের মধ্যে গত ৮ অগস্ট লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল পেশ করেছিলেন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রী রিজিজু। বিলটি ‘অসাংবিধানিক এবং মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী’ বলে অভিযোগ তুলে বিরোধীরা একযোগে তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। যদিও ইতিমধ্যেই এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে কংগ্রেস ও এআইএমআইএম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন