সমকালীন প্রতিবেদন : আবার একটা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক? পেহেলগাঁওয়ে যা ঘটলো তার দায় ভারত সরকারের নয় কি? বড় স্টেপ মোদীর। কিন্তু কখন? গোটা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে গেল? কিভাবে বিএসএফ এর চোখ ফাঁকি দিয়ে পেহেলগাঁওয়ে ঢুকল জঙ্গিরা? গুলি চালানো নয়, জানেন জঙ্গিদের এক্স্যাক্ট প্ল্যানটা কি ছিল? এই গোটা ঘটনা ভূস্বর্গের পর্যটনের উপর কতটা এফেক্ট ফেলল? ফের হাতছাড়া কাশ্মীর? জানুন কিভাবে স্বর্গের স্বাদ বদলে গেল নরক যন্ত্রণায়।
২২শে এপ্রিল। কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে হিন্দু পর্যটকদের টার্গেট করলো পাক জঙ্গিরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একের পর এক প্রাণ শেষ হয়ে গেল। রক্তাক্ত হল ভূস্বর্গ। ২৬/১১ পার্ট টু বললেও হবে না, এই কথা ঘুরছে মুখে মুখে। গোটা ভারত চাইছে এই হিন্দু নিধনের পাল্টা অ্যাকশন নিক মোদী সরকার। ইতিমধ্যেই ছুটে গেছেন অমিত শাহ। শ্রীনগরের নিহতদের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সৌদি সফর কাটছাঁট করে ভারতে ফিরেছেন মোদি। দিল্লি বিমানবন্দরে নেমেই বলেছেন, "অপরাধীরা রেহাই পাবে না"। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সেরেছেন বৈঠক। তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠকের রাজনাথ সিং। কিন্তু এসবে ভারত আশ্বস্ত হচ্ছে না। বরং ভারতীয়রা যে প্রশ্নটা তুলছে সেটা হল, পেহেলগাঁওয়ে যেভাবে বেছে বেছে ধর্ম জেনে হিন্দুদেরকে গুলি করে মারল জঙ্গিরা, তাতে আরও একটা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এর মতো সিদ্ধান্ত কি নেবে তাহলে মোদী সরকার?
একইসঙ্গে সোস্যাল মিডিয়ায় নিন্দার ঝড় বইছে। যা ঘটেছে তার দায় নেবে কে? যাকে পৃথিবীর জন্নত বা ভূস্বর্গ বলা হয়, যেখানে গেলে মানুষ মনে করে এই স্বর্গে মরেও শান্তি। সেখানেই কিনা ছুটে এলো সত্যিকারের বুলেট? যে বুলেট তৈরি হয়েছে চিনে কিংবা আমেরিকার কারখানায়। আর যে বন্দুক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ঝরে পড়েছে সেগুলো একে ৪৭ কিংবা একে ৫৬! তখন মুহূর্তের স্বর্গের স্বাদ বদলে যায় নরক যন্ত্রণায়। কেন? অমিত শাহ বুক বাজিয়ে মাওবাদী নিকেশের দাবি করছেন, যখন এদেশ থেকে নকশালপন্থীদের নির্মূল করে ছাড়ার চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন, তখন কাশ্মীরে জঙ্গি দমনে এই হাল কেন?
যে পরিস্থিতি তৈরি হলো তার পরিপ্রেক্ষিতে যে কথাগুলো উঠে আসছে আজ, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের মতো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবং তার পরবর্তীতে শান্তিপূর্ণভাবে বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর মোটের উপর শান্তই ছিল বলা যায়। যদিও এর মধ্যেও বেশ কয়েকবার জঙ্গিরা ছোটবড় হামলা চালানোয় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু, পেহেলগাঁও এর জঙ্গি হামলার পর ফের নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তাহলে কি কাশ্মীরে শান্তি ফেরাতে কেন্দ্র পুরোপুরি ব্যর্থ? তাছাড়া মঙ্গলবারের হামলার কয়েকদিন আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গোলা বর্ষণ চালাচ্ছে পাক বাহিনী। যা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে অলরেডি ভঙ্গ করে।
পাকিস্তানের গোলা বর্ষণের অর্থই অনুপ্রবেশ। গোলা বর্ষণের আড়ালেই সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গি ঢোকায় পাক বাহিনী। এবারেও সম্ভবত তাই ঘটেছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। যা দেশের গোয়েন্দা বাহিনীর পুরোপুরি ব্যর্থতা বলেই অনেকে মনে করছেন। একইসঙ্গে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের একাংশ তো এটাও বলছেন যে মাওবাদী নিকেশের কাজ সহজ, কিংবা মায়ানমারের মতো আপেক্ষিকভাবে দুর্বল দেশের প্ররোচনায় মণিপুর হিংসা থামাতে কেন্দ্র সফল হলেও পাকিস্তানের চক্রান্তের সামনে এখনও সমাধানের পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে মোদী সরকার। বুঝতে হবে প্রতিবেশী দেশ নয়, নিজের দেশেই বেড়াতে গিয়ে যেভাবে একের পর এক হিন্দু তরতাজা প্রাণের বলি হল, তা খুব স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটা তুলছে তা হলো, পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে এই জঙ্গিরা কিভাবে অনুপ্রবেশ করলো।
বিএসএফ সহ গোটা সীমান্ত এলাকায় ছিল ‘হাই অ্যালার্ট’। তবুও অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে কিভাবে এই দল উপত্যকার ভিতরে ঢুকে পহেলগাঁওয়ের মতো পর্যটন এলাকায় হামলা চালাল? সেটা ভেবেই অবাক সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরাও। প্রশ্ন আরো আছে, সীমান্তে সেন্সর, নজরদারি ড্রোন, থার্মাল ইমেজিং এসব সত্ত্বেও তাদের গতিবিধি ধরতে ব্যর্থ কেন ভারতের বাহিনী? কোথায় ফাঁক ছিল? এটা তো পরিষ্কার পেহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় ছিল নিখুঁত পরিকল্পনা। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ সূত্রে খবর, প্রথমে আইডি বিস্ফোরণের ছক করেছিল জঙ্গিরা। তবে পরে পরিকল্পনা বদলে দু’টো দলে ভাগ হয়ে যায় জঙ্গিরা। জঙ্গিদের পরনে ছিল পুলিশের পোশাক। কেউ কেউ আবার সেনার পোশাক পরেও এসেছিল। একে ৪৭ নিয়ে পর্যটকদের উপর হামলা চালায় তারা। দিন কয়েক আগেই ভারতে আসে। এমনকি এলাকা পরিদর্শনও করে যায়। অর্থাৎ এলাকায় রেইকি চালিয়ে তারপরেই ঘটানো হয়েছে এই ঘটনা।
অলরেডি মঙ্গলবার জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)। টিআরএফের উত্থান হয় ২০১৯ সালে। তখন সবে সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’-র অবলুপ্তি হয়েছে। ঠিক সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝেই পাক জঙ্গিগোষ্ঠী লষ্কর-ই-তৈবার ‘ছায়া সংগঠন’ হিসাবে উঠে আসে টিআরএফ। সেই সংগঠনেরই পাঁচ-ছ’জন আচমকাই মঙ্গলবার দুপুরে পহেলগাঁওয়ে হামলা চালায়। কিন্তু কারা হামলা চালিয়েছে? অলরেডি তাদের স্কেচ, ছবি, নাম সবটাই সামনে চলে এসেছে। পহেলগাঁওয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত চার জঙ্গিকে শনাক্ত করেছে ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। ইতিমধ্যে চারজনের ছবিও প্রকাশ করে পরিচয় জানানো হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, চার জঙ্গি হল আদিল, আসিফ ফুজি, সুলেমান শাহ এবং আবু তালহা। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ওই তিন জঙ্গিই টিআরএফের সদস্য। তবে হামলার মূল চক্রী সইফুল্লা খালিদ ওরফে সইফুল্লা কাসুরি। সে লষ্করের অন্যতম প্রধান। এ ছাড়াও, এই জঙ্গিগোষ্ঠীর অন্যতম মাথা তথা ভরতের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা হাফিজ সইদের ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচিত সইফুল্লা। এখন এই মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ভারত সরকার নেক্সট কি স্টেপ নেবে সে দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ।
অন্য দিকে, জম্মু ও কাশ্মীর সরকার নিহতদের পরিবারপিছু ১০ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি গুরুতর জখম ব্যক্তিদের দু’লক্ষ এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর আহতদের এক লক্ষ টাকা করে আর্থিক সাহায্য করা হবে বলেও জানানো হয়েছে। কিন্তু যা হল, তারপর কাশ্মীর ভ্রমণের স্বপ্ন আপাতত স্থগিতই রাখছে মানুষ। বলতেই হচ্ছে এই ঘটনা কাশ্মীরের পর্যটন ক্ষেত্রেও একটা বড়সড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। হ্যাঁ, বেশ কয়েক বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছিল ভূস্বর্গ। সারা দেশের তো বটেই, বিদেশের মানুষও কাশ্মীর ভ্রমণে আসতে শুরু করেছিলেন। তাই স্থানীয় মানুষের মনে তৈরি হচ্ছিল ফের নতুন করে ব্যবসাপাতির স্বপ্ন। কিন্তু সবটাই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। যা ২৬/১১–র স্মৃতিকে আরো একবার উসকে দিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন