সমকালীন প্রতিবেদন : কে বলে বাঙালি ব্যবসা করতে পারে না? মিথ ভেঙে দিয়েছেন বাংলার মলয় দেবনাথ। শিক্ষাগত যোগ্যতা কত জানেন? শুনলে আকাশ থেকে পড়বেন। ভাববেন এও কি সম্ভব? ক্যাটারিং কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছে। ১৯ বছর বয়সে লড়াই শুরু। দিল্লি বদলে দিল বাঙালি ছেলেকে। মলয় দেবনাথ এর সাকসেস স্টোরি সিনেমাকেও হার মানাবে। উত্তরবঙ্গের নাম উজ্জ্বল করেছেন মলয় দেবনাথ। উত্তরবঙ্গের এক প্রান্তিক গ্রামের, সামান্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ এক ছেলে।
পকেটে ১০০ টাকা নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন। এখন এই মলয় দেবনাথ এর স্ট্যাটাস জানেন? ২০০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। দেবনাথ ক্যাটারার্স অ্যান্ড ডেকরেটর্সের মালিক। ক্যাটারিং ব্যবসার পাশাপাশি ছয়টি ট্রেনে প্যান্ট্রি কার পরিচালনা করে তাঁর সংস্থা। আজ চা বাগান সহ সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁর সম্পত্তি। কিন্তু কিভাবে মলয় দেবনাথ এর কেরিয়ার গ্রাফ এতো উর্ধ্বমুখী? কেনই বা ১০০ টাকা থেকে করতে হয়েছিল লড়াইয়ের শুরু?
জানা যায়, ১৯৩৫ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছিলেন মলয় দেবনাথের ঠাকুরদা। তাঁদের পরিবার ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল, তাঁতের ব্যবসা ছিল। গ্রামের অভাবি শিশুদের জন্য স্কুল তৈরি করতে, তিনি জমিও দিয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা তাঁদের পরিবারকে অত্যন্ত সম্মান করত। সেই স্কুল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, কথায় বলে না সুখ সকলের কপালে সয় না। মলয় দেবনাথের জীবনটাও খুব একটা মসৃণ ছিল না। তাঁর যখন মাত্র ৬ বছর বয়স, সেই সময় রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তাঁদের তাঁত কারখানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের ব্যবসা।
যদিও তাদের পরিবার ফের তাঁতের ব্যবসা শুরু করে। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, কখনই আগের অবস্থা ফেরেনি। তাই, বাধ্য হয়ে গত শতাব্দীর আটের দশকের প্রথম দিকে, ব্যবসা বন্ধ করে মলয় দেবনাথের বাবা হন্যে হয়ে কাজ খোঁজা শুরু করেন। বাড়িতে মলয় ছাড়াও ছিলেন তাঁর দিদি এবং তাঁর দুই ছোট ভাই। কারোরই তখনও স্কুলের পড়াশোনা শেষ হয়নি। মলয় দেবনাথ স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি, গ্রামে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান চালাতেন। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরই অবশ্য পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৮৮ সালে মায়ের কাছ থেকে একটা ১০০ টাকার নোট নিয়ে পাড়ি দেন দিল্লিতে। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯। রাজধানীতে পৌঁছে মলয় দেবনাথ এক ক্যাটারিং সংস্থায় কাজ শুরু করেন। খুব সামান্য টাকায় দিন-রাত পরিশ্রম করতে হতো। থালা-বাসন পরিষ্কার করা, টেবিল পরিষ্কার করার কাজ নেন। তবে তিনি ভেঙে পড়েননি। বুঝেছিলেন তাঁকে লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য কোনো না কোনো পয়েন্ট থেকে একটা শুরু করতে হবে। অত্যধিক কাজের চাপে, তাঁর সহকর্মীদের অধিকাংশই কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু, কঠোর পরিশ্রম করে ওই ক্যাটারিং সংস্থার মালিকের ভালবাসা এবং সম্মান অর্জন করেছিলেন মলয়। যার জেরে মাত্র এক বছরেই তাঁর বেতন মাসে ৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা হয়ে যায়। কিন্তু, তারপরও বাড়িতে কোনও টাকা পাঠাতে পারতেন না। ওভারটাইম করতেন। দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ। না, এখানেই থেমে থাকেননি মলয়। দিল্লির এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মে সুপারভাইজার পদে যোগ দেন তিনি। একই সঙ্গে, ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্টের একটি কোর্স করেছিলেন তিনি।
এই ইভেন্ট সংস্থায় কাজ করার সময় মলয় দেবনাথ অনেক নতুন বন্ধু পেয়েছিলেন। যাঁরা পরে তাঁকে তাঁর নিজস্ব ক্যাটারিং সংস্থা চালু করতে সাহায্য করেছিল। সংস্থাটি অনেক বড় বড় পার্টি অ্যারেঞ্জ করত। ফলে হসপিটালিটি বা আতিথেয়তায় যেমন বেড়েছিল তার জ্ঞান, তেমনই বেড়েছিল যোগাযোগ। আর এরপরই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে শুরু করেন তাঁর নিজস্ব ব্যবসা দেবনাথ ক্যাটারিং অ্যান্ড ডেকরেটর্স। এই যে প্রায়শই বলা হয় বাঙালিরা নাকি ব্যবসা করতে পারে না। কারণ তারা পরিশ্রম করতে পারে না! সেটা যে কতটা ভুল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মলয় দেবনাথ। মলয় দেখিয়ে দিয়েছেন, বাঙালিরাও কঠোর পরিশ্রম করতে পারে। প্রমাণ করে দিয়েছেন জেদ আর চেষ্টা থাকলেই উপায় হয়।
বর্তমানে তাঁর সংস্থা দিল্লি, পুনে, জয়পুর, আজমের এবং গোয়ালিয়র সহ ভারতীয় সেনার ৩৫টিরও বেশি ঘাঁটিতে মেস চালায়। উত্তরবঙ্গে একের পর এক চা বাগান কিনেছেন তিনি। সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। তাঁর দুই মেয়ে এখন পুনে ও অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করে। তবে, এতো সাফল্য পেয়েও মলয় দেবনাথের পা আজও রয়ে গিয়েছে মাটিতেই। এখনও খুব সহজ সরলভাবে জীবনযাপন করেন তিনি। চলেন বাস্তবের মাটিতে পা রেখে। এই কারণেই হয়তো মলয় দেবনাথ বাকি বাঙালিদের কাছে অনুপ্রেরণা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন