সমকালীন প্রতিবেদন : বিদেশের 'স্লো লিভিং' বাংলাতেও ট্রেন্ডে। ফিরছে সেকেলে ভাত ঘুম। কেউ কেউ থাকছেন ইন্টারনেট থেকেও দূরে। বিদেশের চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে চাষবাসে মন দিচ্ছে মানুষ। বেছে নিচ্ছেন গ্রামকে। জীবন চক্র যেন বদলে যাচ্ছে। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে মানুষ উপভোগ করতে চাইছে ধীর স্থির ভাবে।
কাকে বলে 'স্লো লিভিং'? নাভিশ্বাস তুলে দৌড়ানোর বিরুদ্ধে সমাজের একাংশের মানুষ। বিষ থেকে সরছেন দূরে। কর্পোরেট ব্যস্ততা, বেশি রোজগারের চাপ, কম বয়সে অনেক খ্যাতির জন্য দৌড়, এসব অতীত? কেন উল্টো পথে হাঁটার প্রবণতা? কীসের মোহ? বিস্তারিত থাকছে আজকের এই প্রতিবেদনে।
'স্লো লিভিং' এর একটা অদ্ভুত টান আছে। এই সময় দাঁড়িয়ে এ এক অদ্ভুত আকর্ষণ মানুষের কাছে। যেমন ধরুন আমেরিকা। সেখানকার প্রযুক্তি, ব্যস্ততা আর স্মার্ট লাইফস্টাইল। সেসব পার্মানেন্টলি ছেড়ে কেউ ফিরতে পারে গ্রামে? ভাবা যায়? এমনটাই এখন আখছাড় ঘটছে বাস্তবে। বিদেশ থেকে চাকরি ছেড়ে কত মানুষ গ্রামে ফিরে চাষাবাদ শুরু করছেন। মাটির বাড়ি বানাচ্ছেন। বাঙালির পুরনো খাদ্যাভ্যাসে ফিরে যাচ্ছেন। নিজেদের জমি থেকেই ফল-সব্জি, চাল উৎপাদন করে জীবনযাপন শুরু করছেন।
এ যেন জীবনের এক নতুন অধ্যায়। সবকিছু দ্রুত ফাস্ট পাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা সেটাকেই ত্যাগ করছেন এই ধরনের মানুষেরা। গতি কমিয়ে আনছেন তাঁদের নিজেদের জীবনের। বাচ্চাকে ভুলিয়ে রাখতে প্লাস্টিকের খেলনা, সিন্থেটিক পোশাক, মোবাইল-ট্যাব কিনে দিচ্ছেন না। বরং সন্তানের জন্য সময় বের করছেন তাঁরা। গোটা বই এক নিমেষে শেষ করে ফেলতে পারছেন। এটাই 'স্লো লিভিংস'!
আমেরিকা ফেরত অপরাজিতা দেবলের সংসার বীরভূমে দু একর জমির উপর এভাবেই গড়ে উঠেছে। সেখানে তাঁরা চাষাবাদ করেন। নিজেরা নিজেদের মতো করে সময় কাটান। গ্রাম্য জীবনযাপন করেন। এই পরিবারটা 'স্লো লিভিং' এ বিশ্বাসী। এমন জীবনে যে দুশ্চিন্তা নেই, তা কিন্তু নয়। এখন চাষাবাদ থেকেই তাঁদের আয়। যেখানে অনিশ্চয়তা রয়েছে। আগের মতো প্রচুর আয় নেই।
তবে একটা কথা কি বলুন তো, যারা স্লো লিভিং এ বিশ্বাসী, তাঁদের কাছে সম্পদের সংজ্ঞা পাল্টে যায়। হয়তো বড় বাড়ি, গাড়ি করার মতো টাকাপয়সা তাঁদের থাকে না। কিন্তু সময় থাকে হাতে। তা অমূল্য। ইচ্ছে মতো কাজ করার সুযোগ। অবসর। বেড়াতে গেলেও অনেক দিন সময় নিয়ে ঘোরা। ফেরার তাড়া না থাকা। সময় নিয়ে ট্রেনে চেপেই যাওয়া। রোজের খাবার তৈরির জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া।
যেমন, ধান থেকে চাল হওয়ার পর সেই চালকে পুরনো হতে দেওয়া। তারপর রান্না। শাকসব্জির ক্ষেত্রেও এক নিয়ম। আচার, জ্যাম-জেলি সব হোমমেড। সন্তানকে প্রকৃতির মাঝে বড় করতে পারা। গ্রামের শিশুদের সঙ্গে মাঠে খেলা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তুলনায় কমিয়ে আনতে পারা। সন্তানের উপর কিছু চাপিয়ে না দেওয়া। মোদ্দা কথা কর্পোরেট এর চাকচিক্য থেকে, শহুরে জীবন থেকে, ইঁট কাঠ পাথরের রুক্ষতা থেকে অনেক দূরে হয় "স্লো লিভিং"।
এক টুকরো সবুজ গ্রামের পথে ঘুরে ঘুরে ফ্রেশ অক্সিজেন নেওয়া, উনুনের রান্না, মাটির দাওয়ায় বসে কাঁসার বাসনে খাওয়া..! 'স্লো লিভিং' এ মানুষ বুঝতে পারে এ জীবন অনাবিল আনন্দের। অনেকে আবার 'স্লো লিভিং' কি জিনিস তা বোঝেন না! কিন্তু ধীর গতির জীবনযাপনেই বিশ্বাসী, এমন মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। এই যে প্রকৃতির একটা ছন্দ রয়েছে। সূর্য ওঠে, ফুল ফোটে, চাঁদ ওঠে, সেই ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাইছে আজকাল কিছু মানুষ।
প্রতিযোগিতার দৌঁড়ে সম্পর্কগুলো যে শিথিল হতে শুরু করেছে, সেটা থেকে দূরে থাকতে চাইছেন তাঁরা। তাঁরা বলছেন, এই ধীর গতির জীবনের নাম যদি স্লো লিভিং হয়, কম খরচে বাঁচতে চাওয়া যদি স্লো লিভিং হয়, ইন্টারনেটে অর্ডার না করে পায়ে হেঁটে বাজারে গিয়ে থলে ভর্তি করে বাজার আনা যদি স্লো লিভিং হয়, তাহলে তাঁরা তাতেই বিশ্বাসী। 'ধীরেই বাঁচি'। এ যেন এক মন্ত্র। যা জীবনকে চিনতে, বুঝতে, বাঁচতে শেখায়। জীবনকে উপভোগ করতে শেখায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন