সমকালীন প্রতিবেদন : এ এক অন্য ধারার গল্প। আসলে গল্প নয়। গল্পের মতোই এক চরম বাস্তব। ১৫০ বাচ্চার দায়িত্ব কাঁধে। এই ছেলেটা একাই একটা আস্ত গ্রামকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। যখের ধন নেই তাঁর কাছে, কোটিপতিও নন। গয়না বিক্রি করেই সামলে চলেছেন পরিস্থিতি। শিশু থেকে মহিলা, আজ সবার 'মসিহা' ছোটুদা। তিনিই ঝাড়গ্রামের ভগবান।
ভালো নাম স্নেহাশীষ দুর্লভ। সত্যি নামের সঙ্গে কর্মের মিল আছে। নিঃস্বার্থভাবে নিজের কর্মে অবিচল স্নেহাশীষ। সত্যিই এমন মানুষ পাওয়া দুর্লভ। হয়ে উঠেছেন দেড়শ ১৫০ বাচ্চার 'বাবা'! যখন এক সন্তান সামলাতে নিজের বাবা-মা হিমশিম খায়, তখন সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে গ্রামের ১৫০ শিশুর দায়িত্ব নিজের কাঁধে হাসিমুখে তুলে নিয়েছেন।
ঝাড়গ্রামের শিলদা গ্রামের বছর ৩৫ এর স্নেহাশিস পেশায় একজন বিউটিশিয়ান। গ্রামের ছোট্ট বিউটি পার্লার চালিয়ে তা থেকে আর কতই বা আয়? কিন্তু সেই স্বল্প আয়ে যেখানে সংসার চালানোটাই রীতিমতো চ্যালেঞ্জের বিষয়, সেখানে স্নেহাশিস অতগুলো বাচ্চার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ চালানোর পাশাপাশি তাদের আনুষাঙ্গিক খরচের দায়িত্বও সামলান। কিন্তু সমাজসেবা করা তো এত সোজা কথা নয়। তার জন্য টাকা লাগে। আর অবশ্যই ইচ্ছে থাকতে হয়। তবেই না উপায় হয়!
বাবা মা অঢেল টাকা রেখে যাননি স্নেহাশিসের জন্য। স্নাতক হওয়ার পর ২০০৯ সালে তিনি করেন বিউটিশিয়ান কোর্স। সেই সময় থেকেই একটু একটু করে তাঁর বিউটি পার্লারের পরিচিতি বাড়ে। কারণ, তখন ওই এলাকায় তেমন কোনও বিউটি পার্লার ছিল না। একইভাবে গ্রামীণ এলাকায় ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার জন্য সরকারি বিদ্যালয়ের পর তেমন আর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। মানুষের মত মানুষ হওয়া তো দূরের কথা, মাওবাদী সময়কালে পড়াশোনার তেমন ধারে কাছে যেত না ওই অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা।
ফলে তখন থেকেই তাঁর মনে ছিল অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছে। শুরু হয়েছিল ২৬ জনকে দিয়ে, এখন ছোটুদা "মহীরুহ"! স্নেহাশীষ থেকে ছোটু দা হয়ে ওঠার কাহিনীটা বেশ করুণ। বাধ্য হয়ে এই কাজে সাহায্য পেতে তিনি ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়েছেন। শিশুদের পড়াশোনার পেছনে সেই টাকা খরচ করেন। কিন্তু সেই লোন সময়মতো শোধ করতে না পারায় তাঁকে অপমানিতও হতে হয় ব্যাঙ্ক কর্মীদের কাছে। তারপরেও নিজের কাজ এবং টার্গেটের প্রতি অবিচল থেকেছেন সবার প্রিয় ছোটুদা।
শুধু শিশুদের পড়াশোনার দায়িত্ব নয়, প্রতিদিন তাদেরকে টিফিনও দেন স্নেহাশীষ। শুনলে অবাক হবেন, একটা সময়ে বাচ্চাদের পুজোর জামা কিনে দিতে তিনি বাড়িতে থাকা গয়নাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। স্নেহাশীষের এই লড়াই দীর্ঘদিনের। ছোট ছোট শিশুদের পাশাপাশি তিনি মহিলাদেরকেও স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে লড়ে চলেছেন। গ্রামের প্রায় ৯০ জন মহিলাকে একদম বিনামূল্যে বিউটিশিয়ানের কোর্স শিখিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ বিউটিশিয়ানের কাজ করে ভালো টাকা উপার্জন করছেন। কতজনকে স্বাবলম্বী করেছেন এই ছোটুদা। গ্রামের প্রতিটা মানুষের যেকোনো বিপদে সবার আগে ছুটে যেতে দেখা যায় ওই ছেলেটিকে। সবার উদ্দেশ্যেই নিজের সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা যায়।
আসলে মন থেকে কিছু চাইলে সেই উদ্দেশ্য সফল হবে না, এমনটা খুব কমই হয়। টাকা না থাকতে পারে, স্নেহাশীষের একটা সুন্দর মন আছে। ২০০৯ সাল থেকে এক এক করে প্রান্তিক এলাকায় অসহায় ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কখনও কটুক্তি আবার কখনও আশীর্বাদ, সব নিয়েই তাঁর পথচলা। আপাতত ওই ছোট ছোট শিশুগুলোর মুখের নির্মল হাসিটুকুই ছোটুদার জীবনের আশা-ভরসা। ভবিষ্যতে তাঁর ইচ্ছে অসহায় ছেলেমেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় তৈরি করা।
না, এখনও কোনো সরকারি সাহায্য কিংবা কোনো ব্যক্তিগত মাধ্যম থেকে সাহায্য আসেনি। ফেসবুকে তাঁর কাজের ভিডিও দেখে অনেকেই তাঁকে সাহায্য করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত আর্থিক দিক থেকে এগিয়ে আসেন না কেউই। শুধু প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য পান তাঁর তিন বন্ধু, পিসিমা ও বোনদের থেকে। কিন্তু গ্রামের জন্য ভবিষ্যতের স্বপ্নপূরণ এত সহজ হবে কি ছোটুদার জন্য? লাখ নয়, এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন