সমকালীন প্রতিবেদন : সৌমিতা। রোজ সকাল থেকে রাত, ট্রেন টেনে ছুটছেন গন্তব্যে। ছক ভাঙা ছাঁচে ফেলে গড়েছেন নিজেকে। স্কুলের কাজ ছেড়ে আলো হয়ে রেল ট্র্যাকে পথ দেখাচ্ছেন হাজার হাজার যাত্রীদের। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে লোকো পাইলট হওয়ার গল্প। এক সাধারণ সাদামাটা বাঙালি মেয়ের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার গল্প। কি? আপনিও দিশেহারা? জানেন? কখন, কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন জীবনে? পাঠ দিচ্ছেন সৌমিতা রায়।
জীবনের বাঁধাধরা গতে না হেঁটে, নতুন কিছু করার স্বপ্নই রেল ট্র্যাক পর্যন্ত টেনে এনেছে নদীয়ার সৌমিতাকে। এখন ১২ বগির ইলেকট্রিক লোকাল ট্রেন নিয়ে তিনি ছুটে চলেন এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে। সত্যিই দশভূজা সৌমিতা! না হলে সংসার সামলে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া! সে তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। আসলে নিজের স্বপ্নকে ছুঁতে পারলে বোধহয় এমনটাই হয়। রোজকার কাজে একঘেয়েমি আসে না। ক্লান্তিহীন হাসিমুখে দিব্যি ছুটে চলা যায়। আসলে প্রাপ্তিটাও যে কম নয়। ইস্টার্ন রেলের প্রথম বাঙালি মহিলা লোকো পাইলট বলে কথা। নদিয়া পালপাড়ার ৩৭ বছরের সৌমিতা রায়।
নদীয়ারই বীরনগরে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। স্থানীয় শিবকালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস। পরে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে পড়া শুরু। কিন্তু সেই পড়া আর শেষ হয়নি। মাঝপথেই ইতি টানতে হয় সৌমিতাকে। খুব স্বাভাবিক নয় কি? বাবার কটন মিলে কাজ। ঘরের যা পরিস্থিতি ছিল, তাতে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে উঠেছিল। সেইসময় পরিবারের আর্থিক অবস্থার কারণে একটা চাকরির খুব দরকার। তাই ইংরেজি অনার্স পড়া ছেড়ে পারিবারিক কারণে চাকরির খোঁজ শুরু করতে বাধ্য হন সৌমিতা। সঙ্গে ইছাপুর মেটাল এন্ড স্টিল ফ্যাক্টরির টেকনিক্যাল অ্যাপ্রেন্টিস কোর্স কমপ্লিট করেন।
কোর্স শেষে এনসিটিভিটি সার্টিফিকেট পান। শুরু করেন একের পর এক সরকারি পরীক্ষায় বসা। ২০১০ এ রেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকো পাইলট পোষ্টের পরীক্ষায় বসেন। সেখানেই এনসিটিভিটি সার্টিফিকেট কাজে লাগে। একদিকে নিজেকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছনোর তাগিদ, অন্যদিকে পরিবারকে আর্থিক অনটন থেকে বাঁচানোর লড়াই। ২০১১ র জানুয়ারিতে কৃষ্ণনগর দেশবন্ধু কালীনগর স্কুলের প্রাথমিক বিভাগে শিক্ষকতার চাকরিতে যোগ দেন। বুঝতে পারিনি লিখিত পরীক্ষায় প্রথমবারেই সাফল্য পাবেন।
সাইকোলজিকাল টেস্টের অ্যাডমিট কার্ড আসার পর বিষয়টায় গুরুত্ব দেন। সেই সময় অনেকেই নাক কুঁচকেছিলেন। সৌমিতার লোকো পাইলট হওয়ার স্বপ্নকে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেছিলেন। "ট্রেন চালানো মেয়েদের কাজ নয়" সবাই বলেছিলেন এক কথা। শুধু সমর্থন করেছিলেন বাবা-মা। মেয়ের স্পর্ধা নিয়ে যখন গোটা সমাজ আঙুল তুলছে, তখন মা বাবার পাশে থাকাই সৌমিতাকে নিজের টার্গেটের দিকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়।
২০১১ তেই স্কুলের চাকরি ছেড়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকো পাইলট হিসেবে শিয়ালদা ডিভিশনে জয়েন করেন। ট্রেনিং শেষে শিয়ালদা ডিভিশনে ইএমইউ লোকো পাইলট বা মোটরম্যান হিসেবে দায়িত্ব সামলানোর কাজ শুরু করেন।
আজ বন্ধুর মতো তাঁর পাশে রয়েছেন স্বামী বরুন মোদক। বাবার মৃত্যুর পর মা এখনো মেয়েকে সাহস যুগিয়ে চলেছেন। জীবনের বাঁধাধরা ছক ভেঙ্গে নতুন কিছু করার সময় প্রতিকূলতা আসবেই, বাধা আসবে। কিন্তু নিজের লক্ষ্য পূরণে অবিচল থেকেছিলেন সৌমিতা। তাই আগামী প্রজন্মকেও তাঁর মেসেজ "সময় লাগলেও হাল ছেড়ো না"।
ট্রেকিং সৌমিতার ভালবাসা। পাহাড় সৌমিতাকে বড্ড টানে। সুযোগ পেলেই ছুটে যান পাহাড়ের হাতছানিতে। সেই পাহাড় থেকে শক্তি নিয়েই তো কিলোমিটারের পর কিলোমিটার, অক্লান্ত এই বাঙালি কন্যে হাসিমুখে ট্রেন নিয়ে ছুটে চলেছেন। কে বলে? চাইলেই পাওয়া যায় না! সব সম্ভব। মনে রাখতে হবে, ধৈর্য'ই অ্যাসেট। থাকতে হবে চেষ্টাও। আর উপায় খুঁজে বের করতে হবে নিজেকেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন