সমকালীন প্রতিবেদন : মাঝপথেই আরজি কর কাণ্ড থেকে সরে দাঁড়ালেন নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী বৃন্দা? মনোমালিন্য? কেস ছাড়লেন কেন? সিবিআই মিথ্যা বলছে? রাজ্য পুলিশ থেকে সিবিআই, রাজ্য সরকার থেকে সুপ্রিমকোর্ট? কেন সবেতেই অসন্তোষ? দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিও আস্থা রাখা যাচ্ছে না? এক্স্যাক্টলি কি চাইছে নির্যাতিতার পরিবার?
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ, খুনের মামলায় নির্যাতিতার পরিবারের হয়ে লড়ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার। কিন্তু হঠাৎ করেই বুধবার তিনি সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেন। মানে এটাই দাঁড়ায়, এবার থেকে আরজি কর মামলার শুনানিতে নির্যাতিতার পরিবারের পক্ষে আর সওয়াল করবেন না বর্ষীয়ান এই আইনজীবী। না, এমনি নয়। কেন তিনি দায়িত্ব ছাড়লেন, তা এক্সপ্লেইনও করেছে বৃন্দার দফতর। কিন্তু কেউ কেউ বলছেন, সেই ব্যাখ্যার সঙ্গে যা ঘটেছে, তার হিসেব ঠিক মিলছে না।
হিসেবে পরে আসছি। আগে জানা যাক, কি বলেছেন বৃন্দা। ‘‘কিছু নির্দিষ্ট কারণ এবং পরিস্থিতির জন্য বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত তিন মাস ধরে নিয়ম-নীতি মেনেই যাবতীয় আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের সঙ্গেও সহযোগিতা করা হয়েছে’’ হুবহু এটাই বলেছেন। সেক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন, কি এমন পরিস্থিতি তৈরি হল, যে কারণে তাঁকে এই কেস থেকে সরে দাঁড়াতে হলো? কারণ যাই হোক, নিজের দায়িত্ব থেকে কিন্তু হঠাৎ সরে যাননি বৃন্দা। দায়িত্ব ছাড়ার বিষয়ে নিম্ন আদালতকে জানিয়েছেন তিনি।
তবে, বেসিক্যালি যে ইস্যুতে ধোঁয়াশা সেটা হলো, মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানি ছিল। সেই শুনানিতেও নির্যাতিতার পরিবারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন বৃন্দাই। সওয়াল করার সময় আদালতে তিনি জানান, নিম্ন আদালতে প্রায় প্রতিদিন বিচারপ্রক্রিয়ার শুনানি হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ৫১ জনের মধ্যে ৪৩ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি দু’-তিন দিনের মধ্যেই বাকি কয়েকজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করার কাজ হয়ে যাবে। সিবিআই আশা করছে আগামী সপ্তাহের আগে ট্রায়াল শেষ হয়ে যাবে। বৃন্দা বলেছিলেন, ‘‘আমরা আশা করছি অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দেবে সিবিআই। দ্রুত বিচার চাইছেন নির্যাতিতার বাবা-মা। তাঁরা আশা করছেন, এই ঘটনায় আর কেউ জড়িত থাকলে তা খুঁজে বার করবে সিবিআই।’’
অর্থাৎ বৃন্দার কথা অনুযায়ী কেস এখন মধ্যগগনে। সেক্ষেত্রে এই কেস থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনো ইঙ্গিতই ছিল না। কিন্তু তারপর যা হয়েছে সেটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। বৃন্দার কথায়, নির্যাতিতার পরিবার আস্থা রেখেছিলেন সিবিআইয়ে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের শুনানির পরই সিবিআইকে নিয়ে নিজেদের ‘হতাশা’র কথা জানান নির্যাতিতার বাবা-মা। নির্যাতিতার বাবার অভিযোগ, আদালতে দাঁড়িয়ে ‘মিথ্যা’ বলছে সিবিআই। তিনি বলেন, ‘‘আদালতে দাঁড়িয়ে এভাবে মিথ্যা বলা যায়, তা আমরা জানতাম না। সেই মিথ্যার উপর সুপ্রিম কোর্ট নজরদারি চালাচ্ছে। সিবিআই আদালতে বলছে, তারা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। কিন্তু আমরা কিছুই জানতে পারি না।’’ শুধু সিবিআই নয়, সুপ্রিম কোর্টের শুনানি নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন নির্যাতিতার বাবা-মা। আরজি কর মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ আগামী ১৭ মার্চ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কেন এত দিন পরে শুনানির তারিখ দেওয়া হল, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। সঙ্গে এটাও জানান, আইনি পথেই লড়াই চালিয়ে যাবেন।
কিন্তু যে সুপ্রিম কোর্টের উপর অসন্তোষ নির্যাতিতার পরিবারের, মঙ্গলবারের শুনানিতে সেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না জানান, শিয়ালদা আদালতে যদি কোনও কারণে বিচারপ্রক্রিয়া দেরি হয়, তবে তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। এই গোটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্নটা উঠে আসছে, রাজ্য সরকার এবং কলকাতা পুলিশে আস্থা ছিল না নির্যাতিতার পরিবারের। এখন সুপ্রিম কোর্টের প্রতিও অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। সিবিআই'য়েও আস্থা নেই। তাহলে ঠিক কি চাইছেন তাঁরা?
সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে নির্যাতিতার বাবা-মায়ের বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও মঙ্গলবার শুনানির সময় তাঁদের আইনজীবী বৃন্দা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী ওই সংস্থাকে নিয়ে কোনও হতাশা প্রকাশ করেননি। কিন্তু বুধবার দেখা গেল তিনি আরজি কর মামলার দায়িত্ব ছাড়লেন। তাহলে কি নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে আইনজীবী বৃন্দার মধ্যে কোন মতপার্থক্য রয়েছে? মনোমালিন্য থেকে কি এই সিদ্ধান্ত নিলেন বর্ষীয়ান আইনজীবী বৃন্দা? রাজ্য থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, কোনো ক্ষেত্রেই তো আস্থা রাখতে পারছে না নির্যাতিতার পরিবার। সেক্ষেত্রে এখন উপায় কি? ভাবার বিষয়।
গোটা দেশ জানে, কতটা সেনসিটিভ ইস্যু এই আরজিকর কাণ্ড। গত সেপ্টেম্বর মাসে সেই আরজি কর মামলায় নির্যাতিতার পরিবারের পক্ষে লড়ার দায়িত্ব নেন বৃন্দা। তার আগে এই মামলা ওই পরিবারের পক্ষে লড়ছিলেন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য। পরে তাঁর জায়গায় বৃন্দাকে নিয়োগ করেছিলেন নির্যাতিতার পরিবার। প্রায় বিনা পারিশ্রমিকেই এত দিন বিভিন্ন আদালতে আরজি কর মামলায় সওয়াল করেছেন বৃন্দা এবং তাঁর দফতর। শুধু সুপ্রিম কোর্টে নয়, শিয়ালদা আদালতেও আরজি কর মামলার শুনানিতে পরিবারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বৃন্দার দফতরের আইনজীবীরা। এমনকি, বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিন বৃন্দা নিজেও এসেছিলেন শিয়ালদা আদালতে। তারপর প্রতিদিনই তাঁর দফতরের আইনজীবীরা থাকতেন বিচারপ্রক্রিয়ার শুনানিতে। বুধবার সেই দায়িত্বই ছাড়লেন বৃন্দা। যা নিয়ে শুরু হয়েছে জোর সমালোচনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন