ইতিহাসের সাক্ষ্মী মঙ্গলগঞ্জ রাজবাড়ি এবং লুৎফর রহমানের প্রচেষ্টা
রবীন্দ্রনাথ তরফদার
লুৎফর রহমান সম্পাদিত "বাংলার গর্ব মঙ্গলগঞ্জ রাজবাড়ি" গ্রন্থটিতে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বাগদা থানার অন্তর্গত মালিপোতা গ্রাম পঞ্চায়েতে অবস্থিত মঙ্গলগঞ্জের এক বিস্মৃত পর্বের কাহিনি উদ্ঘাটিত হয়েছে। স্থানীয় লেখক ও আঞ্চলিক ইতিহাস সম্পর্কিত বিষয়ে অত্যুৎসাহী লুৎফর রহমান ইছামতি নদীর তীরে জঙ্গলাকীর্ণ ভগ্নদশাগ্রস্ত মঙ্গলগঞ্জের রাজবাড়ি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন প্রায় দুই দশক আগে থেকে।
স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ও আবেদনের মাধ্যমে রাজবাড়ি এবং সংলগ্ন এলাকার সংরক্ষণ-সংস্কারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে তোলেন এবং স্থানটি পরিদর্শন করান।
মঙ্গলগঞ্জ রাজবাড়ি স্থাপন, রাজা ও রাজত্বকাল সম্পর্কে নানা লোককথা, কল্পিত কাহিনী এর প্রকৃত ইতিহাসকে অনেকখানি রহস্যাবৃত করলেও সম্পাদক সহ ৩৭ জন বিশিষ্ট আলোচক ও খ্যাতিমান সাংবাদিক মঙ্গলগঞ্জ রাজবাড়ির লুপ্তপ্রায় অতীতকে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
যতদূর জানা যায়, বনগ্রাম মহকুমা গঠনের পূর্ব থেকেই নদী ও অরণ্যকে কেন্দ্র করে মঙ্গলগঞ্জে গড়ে উঠেছিল জনবসতি। পরে ব্রিটিশ রাজশক্তি শাসিত ভারতে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নবজাগরণ পর্বে ১৮৭১ সালে গোবরডাঙার জমিদার মঙ্গলচন্দ্র আশের পুত্র লক্ষণচন্দ্র আশ কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বংশধরদের নিকট থেকে ভূসম্পত্তি ক্রয় করেন।
আর তারপর সেখানেই এক বিশাল জমিদারির পত্তন করেন। গড়ে ওঠে কাছারি বাড়ি, নীলচাষ, নৌ-বাণিজ্য, হাট বাজার আর রক্ষীবাহিনী। ৬৬ বিঘা জমির ওপর নির্মিত হয় সাতমহলা রাজবাড়ি। পিতা মঙ্গলচন্দ্রের নামে রাজ্যের নামকরণ করেন মঙ্গলগঞ্জ।
গ্রন্থের প্রবন্ধগুলির বেশির ভাগই সুলিখিত। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: সনৎ কুমার নস্কর লিখিত ভূমিকা থেকেই সম্পাদিত গ্রন্থটি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করা যায়। ড: বাসুদেব মন্ডলের কলমে জীবন্ত হয়ে ওঠে অতীত ইতিহাস। ড: শেখ কামালউদ্দিন স্বল্প পরিসরে প্রাচীন রাজকাহিনিকে তুলে ধরেছেন এক নতুন আঙ্গিকে।
সমাজবিদ অজয় মজুমদার নিপুণভাবে ঐ এলাকার লোকজীবন ও আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা করেছেন। নীলচাষ, নীলবিদ্রোহ, ব্রিটিশ নীলকরদের শোষণ ও প্রজাপীড়ণ আর বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু আলোচনা পাঠককে ঋদ্ধ করবে। সাংবাদিক নিরুপম সাহা যথার্থভাবে এই ঐতিহাসিক রাজবাড়ির সংস্কার ও এলাকার মানুষের চাহিদা সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন পেশ করেছেন।
গ্রন্থটি আগামীর আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষকদের কাছে মঙ্গলগঞ্জ নিয়ে কাজ করা অনেকখানি সহজসাধ্য করে তুলবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিহাস অতীতের কথা বলে কিন্তু তাকে হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ। নাহলে কল্পিত কাহিনী তাকে রূপকথায় পরিণত করবে। চাই ইতিহাসের চেতনা, যা অতীতকে চোখের সামনে তুলে ধরবে। সেদিক দিয়ে গ্রন্থটি সাফল্যের তালিকাভুক্ত হবে বলে মনে করি।
গ্রন্থটির প্রচ্ছদ নতুন ভাবনার শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দেয়। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এই বিরল কাজটি নিষ্পন্ন করেছেন অধ্যাপক ড: বাসুদেব মন্ডল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন