দক্ষিণ কলকাতার এবছরের দুর্গাপুজো
স্বপন ঘোষ
রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশন পার করে কলকাতার যে বিপুলাকার অংশ, তাকেই সাধারণভাবে দক্ষিণ কলকাতা বলা হয়। এলাকার বিচারে উত্তর কলকাতার পুজো অনেক কম পরিসরে আবদ্ধ। অনেক কাছাকাছি, প্রায় প্রত্যেক গলিতে। দক্ষিণ কলকাতার পুজো মানচিত্র অনেক ছড়ানো। পায়ে হেঁটে দক্ষিণ কলকাতায় ঠাকুর দেখা বেশ কষ্টকর।
এবছর দক্ষিণ কলকাতার ঠাকুর দেখতে নেতাজী ভবন মেট্রো রেল স্টেশনে নেমে প্রথমে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকি। পর পর দেখে নিই ৭৫ পল্লী সর্বজনীন, ৭৬ পল্লী সর্বজনীন এবং অগ্রদূত উদয় সংঘ। এরমধ্যে ৭৬ পল্লীর পুজো মণ্ডপটি ভারী সুন্দর। টেরাকোটার কাজের দোচালা পুজো মণ্ডপটি বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়।
নেতাজী ভবন মেট্রো রেল স্টেশনের পূর্ব দিকে দক্ষিণ কলকাতা সর্বজনীন দুর্গোৎসবের অসাধারণ দুর্গা প্রতিমা। আয়োজন ও আড়ম্বরে আতিশয্য নেই, কেবল শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় নিখূত নির্মাণ। ভবানীপুর নর্দার্ন পার্কে আয়োজিত ২২ এর পল্লী পুজোমণ্ডপটি দৃশ্য ভাবনায় অনবদ্য। বিরাট মাঠের মধ্যে হোগলার কাজে নির্মিত সুচারু মন্দিরটিতে দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের নির্মাণ ঘরানা লক্ষ্যনীয়।
দক্ষিণ কলকাতায় প্রথম উল্লেখযোগ্য থিম পুজো পেলাম চক্রবেড়িয়া সর্বজনীনের দুর্গাপুজোয়। তাদের পুজোর থিম পুরোনো বাড়ি ভেঙে আবাসন নির্মাণ। বাড়ি ভাঙার প্রভাব মা দুর্গার বাপের বাড়িতেও পড়েছে। কৈলাশ থেকে পুত্র-কন্যাসহ বাপের বাড়িতে এসে উমা প্রায় নিরাশ্রয়। ভেঙে ফেলা বাড়ির রাশি রাশি বাতিল, অবাঞ্ছিত জিনিসের মাঝে মন খারাপ করা মায়ের মূর্তি। আমাদের ভাবতে বাধ্য করে বইকি!
চক্রবেড়িয়ার পুজো পেরিয়ে হাঁটা পথেই দেখে নিলাম পদ্মপুকুর সর্বজনীনের পুজো। এরপর বেশ খানিকটা হেঁটে বালিগঞ্জের মেগা পুজো ম্যাডক্স স্কয়ার এর আভিজাত্যময় পুজোমণ্ডপে পৌছে গেলাম। ম্যাডক্স স্কয়ার মানেই আভিজাত্য, আড্ডা, গান, খাওয়া-দাওয়া। মানুষের ভিড়ে বয়সের ব্যবধান এখানে ঘুচে যায়।
ল্যান্সডাউনের একটা ছোট পুজোর কথা না বলে পারছি না। মৈত্রী সংঘ। ছোট প্যান্ডেল, কিন্তু বিষয় ভাবনায় অভিনব এবং অনুপ্রেরণাধর্মী। ভারতে প্রত্যেক বছর ২.৫ মিলিয়ন অটোমোবাইল সেটআপ বাতিল হয়। বাতিল অটোমোবাইল সেটআপ থেকে কোটি কোটি টন বর্জ্য বেরিয়ে আসে।
মৈত্রী সংঘ বাতিল অটোমোবাইল বর্জ্য দিয়ে তাদের গোটা প্যান্ডেলটা সাজিয়েছে, এমনকি অটোমোবাইলের কয়েক লক্ষ পার্টস দিয়ে তারা গোটা একটা দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করেছে। বাতিল টায়ারের সোফা, বাতিল ফ্রিজের ক্যাবিনেট দিয়ে বুকসেল্ফ, সেলাই মেশিনের বডি দিয়ে ব্যবহারযোগ্য বেসিন, ফুলের টব, খেলনা ইত্যাদি সবই বর্জ্যের ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
দেশপ্রিয় পার্কের পুজো বরাবরের মতই বিশালাকার, কারুকার্যময়। বিপুল জনসমাগম, সর্পিল লাইন, বাড়াবাড়ি কড়াকড়ি এই পুজোতে প্রত্যেক বছরই দেখা যায়। বরং ছোট রাস্তায় স্বল্প পরিসরে আয়োজিত ত্রিধারা সম্মীলনীর পুজো এবছর দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম সেরা পুজো হিসেবে স্বীকৃত। বিষয় বিন্যাস আর আলোকসজ্জার অভিনবত্বে এই পুজো দেখতেই হবে।
ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের পুজো যথাযথ। গড়িয়াহাটের হিন্দুস্থান তরুণ সংঘের উপস্থাপন কেদারনাথের মন্দির। একডালিয়া এভারগ্রিন বরাবরের মতই জমকালো, জনবহুল। হাজার জনতার ভিড়ে এই পুজো সবসময় কলরবমুখর। দুর্গা প্রতিমায় সাঁচী স্তূপের অনুকরণ লক্ষ্যণীয়।
চেতলা অগ্রণী এবং সুরুচি সংঘ বহুদিন থেকেই কলকাতার মেগা পুজো হিসেবে স্বীকৃত। সেখানে শুধুই জনজোয়ার। মানুষের ভিড়ে মানুষ হারিয়ে গিয়ে জাগিয়ে রাখে কেবল কলতান। মানুষের এই ঢল সামলাতে হিমশিম খেতে হয় কলকাতা পুলিশকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন