সমকালীন প্রতিবেদন : বর্তমান বিশ্বে নিরন্তরভাবে বিস্তৃত হতে থাকা রাষ্ট্রগুলির মাঝে একটি ক্ষুদ্র দেশ রয়েছে, যা বাকিদের থেকে অনেকটাই আলাদা। প্রিন্সিপ্যালিটি অফ সিল্যান্ড। ইউরোপের উত্তর সাগরের একটি স্ব-ঘোষিত সার্বভৌম দেশ, যা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়। মাত্র ৫৫০ বর্গমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভূ-রাজনীতির জগতে সত্যিকারের এক অসঙ্গতির সৃষ্টি করে।
ইউরোপের সমুদ্র তীর থেকে মাত্র ১০/১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই সিল্যান্ডের ইতিহাস আসলেই ব্যাপক চতুরতা এবং সংকল্পের একটি আকর্ষণীয় গল্প। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি সমুদ্রবন্দর হিসেবে বর্তমান এই সিল্যান্ডের নির্মাণ। পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক সমুদ্র দুর্গের মতোই প্রয়োজন শেষে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এই কাঠামোটিকেও পরিত্যাগ করে।
এরপর ১৯৬৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ নাগরিক মেজর প্যাডাজ রয় বেটস এবং তার পরিবার এই কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ নেন এবং এটিকে একটি স্বাধীন মাইক্রো-নেশন অথবা অতি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন। তারা এটিকে 'সিল্যান্ড' নামকরণ করেন এবং তাদের নিজস্ব মুদ্রা, আইন এবং সরকার প্রতিষ্ঠা করেন।
এর অতীব ছোট আকার এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির অভাব থাকা সত্ত্বেও, সিল্যান্ডে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সবকিছুই উপস্থিত রয়েছে। এই দেশের নিজস্ব পতাকা, পাসপোর্ট, মুদ্রা এমনকি একজন রাজা এবং রানীও রয়েছেন। অফিসিয়াল ভাষা ইংরেজি, এবং ব্যবহৃত মুদ্রার নাম সিল্যান্ড ডলার।
তবে সার্বভৌমত্বের দাবি থাকা সত্ত্বেও সিল্যান্ডকে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশগুলির দ্বারাই স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এটি মূলত এই কারণে যে, সিল্যান্ডের কোনও ঐতিহ্যগত অঞ্চল নেই। স্থলভাগ নামক কোনও স্থানই দেশটির কাছে নেই। কারণ এটি আক্ষরিক অর্থে সমুদ্রের উপর ভাসছে।
সিল্যান্ডের প্রিন্সিপ্যালিটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বিশ্বে একটি আকর্ষণীয় এবং অনন্য সত্তা হিসাবে রয়ে গেছে। বর্তমানে সিল্যান্ডে মাত্র ২৭ জন মানুষের বসবাস। যদিও এটি ৩০০ জন পর্যন্ত মানুষের বাসস্থান দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। দেশটির নিজস্ব রাজধানী শহরও রয়েছে, যেটিও কিনা এই ক্ষুদ্র কাঠামোর মধ্যেই অবস্থিত।
দেশটি একটি রাজতন্ত্র দ্বারা শাসিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা রয় বেটসকে ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর এখানকার প্রথম রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাইকেল এই সিল্যান্ডের ক্ষমতার লাগাম ধরেন। এর আকার বাদেও সিল্যান্ড বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন বিতর্কের অংশ হয়ে রয়েছে।
১৯৭৮ সালে জার্মান এবং ডাচ নাগরিকদের একটি দল বলপ্রয়োগ করে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সিল্যান্ডারদের দ্বারা তাদেরকে সেই সময় দ্রুত প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৭ সালে সিল্যান্ডকে ই-বেয়েতে বিক্রি করার জন্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু নিলামটি শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হয়। এমনকি ২০১৯ সালে এর কাঠামোটিতে আগুনও লাগে। যার ফলে এটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
তবে এইসব বাধা সত্ত্বেও সিল্যান্ড মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার একটি আকর্ষণীয় এবং স্থায়ী প্রতীক হিসাবে রয়ে গেছে। দেশটি কোনদিনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নাও পেতে পারে।
কিন্তু এর উত্তরাধিকারীরা আগামী প্রজন্মকে অবশ্যই অনুপ্রাণিত করতে থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সিল্যান্ডের প্রিন্সিপ্যালিটি ইউরোপের উত্তর সাগরে ভাসমান থাকবে, ততদিন এটি সারা বিশ্বের মানুষের কল্পনাকে ধরে রাখতে থাকবে এবং শক্তি যোগাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন