বিস্মৃতির চন্দ্রাভিযান
স্বপন ঘোষ
চন্দ্রাভিযানের সাফল্যে এখন গোটা দেশ বুঁদ হয়ে আছে। সত্যিই ভারতবাসী হিসাবে গর্ব করার মত বিষয়ই বটে। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র আর অনটনে মোড়া একশো চল্লিশ কোটি মানুষের দেশ প্রথম বিশ্বের প্রতি প্রতিস্পর্ধা ছুড়ে দিয়ে একেবারে চাঁদে পৌছে যাবে, একথা অনেকেই ভাবতে পারেননি।
অলিম্পিকে যাদের সাফল্য দূরবিন দিয়ে দেখতে হয়, ফুটবলে যারা একশো'র মধ্যেও থাকেনা, যে দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় এবং দারিদ্র সূচক এখন বাংলাদেশেরও নীচে, তারা কিনা চাঁদে পৌছে গেল! সারা দেশের মানুষের পাশাপাশি দেশের প্রধানমন্ত্রীও আবেগের আতিশয্যে ভেসেছেন। এমনকি ইসরো সফর করে সাফল্যে অশ্রুপাত পর্যন্ত করেছেন।
পৃথিবীতে কোনও সাফল্যই সম্ভবত অনায়াসে আসেনা। আমাদের এই সাফল্যের পিছনের ইতিহাসও যথেষ্ট দীর্ঘ এবং সংগ্রামপূর্ণ। ১৯৬২ সালে গঠন করা হয় 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ'। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর উদ্যোগেই এই সংস্থা গড়ে ওঠে এবং তিনিই এই কমিটির প্রধান হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ বিক্রম আম্বালাল সারাভাইকে। তাঁর সঙ্গে মহাকাশ কর্মসূচীতে যোগ দেন প্রখ্যাত পরমানু বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা।
মনে রাখতে হবে, দীর্ঘ প্রায় দুশো বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা– সবকিছুতেই আমরা তখন নিতান্ত অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছি। ষাট-এর দশকের দেশব্যপী খাদ্যসংকট তো প্রায় মিথ এর পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল। তারমধ্যেও কিন্তু পণ্ডিত নেহেরু দেশ গঠন ও ভবিষ্যত বিকাশের পথ তৈরিতে পিছিয়ে আসেননি। এই সময়েই তৈরি হয়েছে একের পর এক আই.আই.টি, বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, পরমানু বিজ্ঞান কেন্দ্র, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
নেহেরুর আমলেই ১৯৬৩ সালের ২১ নভেম্বর কেরলের থুম্বা থেকে ভারত প্রথম মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপন করে। ১৯৬৫ সালে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আমলে থুম্বাতে স্থাপিত হয় 'স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টার'। কৃত্রিম উপগ্রহের সংকেত মাটি থেকে ধরার জন্য আমেদাবাদে গড়ে ওঠে 'এক্সপেরিমেন্টাল কমিউনিকেশন আর্থ স্টেশন'।
১৬৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ভারত সরকারের আনবিক শক্তি দফতরের অধীনে গড়ে উঠল 'ইসরো'। চেন্নাই থেকে ১০০ কিমি দূরে শ্রীহরিকোটা দ্বীপে গড়ে তোলা হল ভারতের পূর্ব উপকূলের রকেট উৎক্ষেপন কেন্দ্র। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন নেহেরু-কন্যা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি। তাঁর আমলেই ১৯৭২ সালে ভারত সরকার মহাকাশ দফতর তৈরি করে ইসরো-কে তার আওতায় আনে। সে বছরেই বেঙ্গালুরুতে তৈরি হয় 'ইসরো স্যাটেলাইট সেন্টার'।
১৯৭২ সালে শ্রীমতি গান্ধির আমলেই ইসরোর চেয়ারম্যান হন বিজ্ঞানী শ্রী সতীশ ধাওয়ান। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৭৫ সালে উৎক্ষেপন করা হয় ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ 'আর্যভট্ট'। ১৯৮৪ সালে তাঁর আমলেই রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারত প্রথম মহাকাশচারী হিসাবে শ্রী রাকেশ শর্মাকে মহাকাশে পাঠায়। শ্রী শর্মা সাফল্যের সঙ্গে তাঁর মহাকাশ যাত্রা সমাপ্ত করে দেশ ও দেশের মানুষকে গর্বিত হওয়ার সুযোগ দেন।
২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর শ্রীহরিকোটা থেকেই পি.এস.এল.ভি.এক্স.এল রকেটে চড়েই উড়ে গিয়েছিল ভারতের প্রথম চন্দ্রাভিযানের যান 'চন্দ্রযান-১'। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন ডঃ মনমোহন সিংহ। ফলে আমাদের ভুললে চলবে না, আজকের এই সাফল্য হঠাৎ করে বা আবেগের বশে আসেনি।
এই সাফল্যের পিছনে আছে অনেক বিজ্ঞানীদের আত্মত্যাগ, কঠোর সাধনা এবং একই সঙ্গে ভারতের পূর্বতন দেশনেতাদের দূরদৃষ্টি, বাস্তবোচিত উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক স্বার্থশূণ্য মনোভাব। আজকের এই সাফল্যের দিনে পূর্বসূরীদের সম্পর্কে দেশের মানুষের উদাসীনতা পীড়াদায়ক বৈকি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন