সমকালীন প্রতিবেদন : রেলের প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই নিয়মিত ঘোষণা হয়, কোন প্লাটফর্মে কোন ট্রেন আসবে। আর শিয়ালদা বা হাওড়ার মতো ট্রেনে তো ঘোষণা হয়েই চলেছে। জমাট বেঁধে, ভিড় করে শিয়ালদা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীরা।
সন্ধে হয়ে গেছে, সকলেরই ঘরে ফেরার তাড়া। অপেক্ষা কেবল ঘোষণার। যে ঘোষণা শুনে তাঁরা জানতে পারবেন, কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ছে তাঁদের বাড়ি ফেরার ট্রেন।
এমনই সময়ে মাইক্রোফোন থেকে ভেসে এল, ‘৩১৮৪১ আপ কৃষ্ণনগর লোকাল ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে।’ এ যেন প্ল্যাটফর্মের নিছক ঘোষণা নয়, পথপ্রদর্শকের বাণী। কারণ, ঘোষণামাত্র স্টেশনের মেন সেকশনের সেই ভিড় হুড়মুড়িয়ে ছুটল নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে।
এ ছবি প্রতিদিনের। একবার নয়, কয়েকশো বার এমন ঘোষণা আর এমন ছুটোছুটির সাক্ষী থাকে শিয়ালদা। কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যে থাকা কেউই জানতে পারেন না, যিনি তাঁদের ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম বাতলে দিচ্ছেন মাইক্রোফোনের ওপার থেকে, তিনি সেই প্ল্যাটফর্ম কখনও চোখে দেখেননি। এমনকি সময় বলার আগে কখনও দেখেননি ঘড়িও। কারণ তিনি চোখে দেখতে পান না। জন্মান্ধ।
কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি ঘোষণা করে চলেছেন। আর হাজার হাজার মানুষ তাঁর ঘোষণা শুনে ছুটে যাচ্ছেন প্লাটফর্মের দিকে। নৈহাটির বাসিন্দা পরিতোষ বিশ্বাস প্রতিদিন ভোর ৫টা নাগাদ নৈহাটি স্টেশনে এসে পৌঁছন প্রথম ট্রেন ধরতে। হাতে একটি সাদা লাঠি। কেউ না কেউ ঠিকই ধরে নেন সে হাত, এগিয়ে দেন ট্রেনের গেটের দিকে।
৬টায় ডিউটি শুরু শিয়ালদা স্টেশনে। কাঁটায় কাঁটায় পৌঁছে যান রোজ। শিয়ালদা নেমে পরিতোষবাবু সোজা চলে যান অ্যানাউন্সমেন্ট রুমে। দায়িত্ব বুঝে নেন, তার পরেই বসে যান কাজে। প্রায় দম ফেলার সুযোগ মেলে না। প্রতি মুহূর্তে ফোন বাজছে। খবর আসছে কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে কোন ট্রেন কখন ছাড়বে।
: এই খবরের ভিডিও প্রতিবেদন দেখতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন :
সেই সব তথ্য দ্রুত হাতে ব্রেইলে লিখে নেন তিনি। কারণ, লিখে না নিলে তো ভুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তার পরে ঠিক সময়ে ঘোষণা করেন মাইক্রোফোনে। আজ থেকে নয়, ৩৪ বছর ধরে ইস্টার্ন রেলের এই কাজের সঙ্গে যুক্ত পরিতোষবাবু।
দৃষ্টি না থাকা সত্ত্বেও তিনি এই কাজ পেয়েছিলেন, সেই জন্য রেলের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। দীর্ঘ কেরিয়ারের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্টেশনে ছিলেন। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে আসছেন তিনি।
তবে তিনি একা নন, পূর্ব রেল সূত্রের খবর, হাওড়া এবং শিয়ালদা স্টেশন মিলিয়ে পরিতোষ বিশ্বাস সহ মোট পাঁচ জন দৃষ্টিহীন ঘোষক রয়েছেন। রেলযাত্রীদের পরিষেবা দিতে পরিতোষবাবুর মতো অন্ধ ঘোষকেরা তাঁদের দায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করে চলেছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন