সমকালীন প্রতিবেদন : আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী, বনগাঁর প্রাক্তন পুরপ্রধান ডা: সুশান্তকুমার সরকার প্রয়াত হলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। রেখে গেলেন তার দুই কন্যা এবং তাঁদের পরিবারকে। মঙ্গলবার ভোররাতে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলায় তাঁর জন্ম। পরবর্তীতে বনগাঁ ঘোষ ইনস্টিটিউশন এবং বনগাঁ হাইস্কুল থেকে স্কুলের পড়াশোনার গন্ডি শেষ করে তিনি কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পান। সেখান থেকে ডাক্তারি পাশ করে রেলের চাকরিতে যোগ দেন। চাকরি করতে করতেই কমিউনিষ্ট পার্টির আহ্বানে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বনগাঁয় ফিরে যোগ দেন দলের কাজে।
যমজ দুই ভাইয়ের মধ্যে সুশান্ত সরকার ছাড়া আর একজন হলেন বনগাঁ হাইস্কুলের অঙ্ক বিষয়ের প্রাক্তন শিক্ষক প্রশান্তকুমার সরকার। সুশান্ত সরকারের দুই কন্যা। অনেক আগেই তাঁদের দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী প্রায় ১৫ বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন।
চিকিৎসক হিসেবে সেইসময় শুধুমাত্র অর্থের দিকে না ছুটে সারা জীবনটাই একপ্রকার দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন ডা: সুশান্ত সরকার। তিনি সবসময় চেষ্টা করতেন দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। সেইসময় মাত্র ২ টাকার বিনিময়ে দরিদ্র অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা করতেন। বিনা পয়সায় ওষুধও দিতেন।
সেইসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে গিয়ে নানাভাবে অসুস্থ, আহত বামকর্মীদের গোপনে চিকিৎসা করতেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি বনগাঁ পুরসভার প্রধানের দায়িত্বভার পালন করেন। সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ হিসেবে সব রাজনৈতিক দলের মানুষের সঙ্গে তাঁর সক্ষতা ছিল।
পুরপ্রধান থাকাকালীন তিনি সেইসময় রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পুরপ্রধান হিসেবে সরকারি গাড়ি ব্যবহারের অনুমোদন পান। কিন্তু ব্যতিক্রমী চরিত্রের এই মানুষটি নিজের সুবিধার কথা না ভেবে সেই জায়গায় একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেন, যা অসুস্থ মানুষের পরিষেবায় কাজে লাগে।
চিকিৎসা পরিষেবার পাশাপাশি ডা: সুশান্ত সরকার নানাধরণের সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি বনগাঁ হাইস্কুল এবং নিউ বনগাঁ গার্লস হাইস্কুলের পরিচালন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব সামলেছেন। এছাড়া, বনগাঁ দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতিও ছিলেন।
সরকারি স্কুল, কলেজের পাশাপাশি তাঁর হাত ধরেই বেসরকারি উদ্যোগে বনগাঁয় প্রথম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি আজীবন স্কুল পরিচালন কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। নির্লিপ্ত এই মানুষটির গোটা জীবনটাই অনাড়ম্বরভাবে কেটেছে।
বয়সজনিত কারণে কিছুটা দূর্বল হয়ে পরলেও জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত নিজের পায়ে চলেফিরে বেড়াতেন। গত ৬ মাস ধরে নিজের পশ্চিমপাড়ার বাড়ি ছেড়ে দুই মেয়ের কাছেই থাকতেন। গত সোমবার রাতে অসুস্থ বোধ করায় রাত সোয়া ১১ টা নাগাদ তাঁকে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার ভোর ৪ টে ৫৫ মিনিট নাগাদ সেখানেই তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পরতেই বনগাঁয় বিশেষ করে বামপন্থীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বনগাঁর বহু মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এদিন পরিজনদের বাড়ি, কর্মস্থল ঘুড়ে বনগাঁ মহাশ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। বর্তমান রাজনীতিতে যেখানে 'সৎ' শব্দটির খোঁজ পাওয়া খুব কঠিন, সেখানে ডা: সুশান্ত সরকারের মতো মানুষ সত্যিই ব্যতিক্রম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন