সমকালীন প্রতিবেদন : বলা হয়ে থাকে, 'ভালোবাসার কোনও বয়স হয় না'। কথাটি যে আসলেই সত্যি, তা দেখিয়ে দিলেন ৬৫ বছরের অপর্ণা চক্রবর্তী এবং ৭০ বছরের সুব্রত সেনগুপ্ত। ভালোবেসে বিয়ে তাঁদের, তবে নিজেদের কম বয়সে নয়। বরং বৃদ্ধাশ্রমে এসে একে অপরের প্রেমে পড়ে নিজেদের বিয়ে সারলেন তাঁরা। সম্প্রতি আইনসম্মতভাবেই তাঁরা বিয়ে করেছেন। এই আজব প্রেমের গল্পটি শুরু হয় ২০১৯ সালে।
নদীয়ার চাকদার লালপুরের বাসিন্দা ছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত। পরিবারে মা, দুই ভাই, তাঁদের স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে নিয়ে ছিল সংসার। রাজ্য পরিবহন দপ্তরে কর্মরত ছিলেন তিনি। সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পর পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে ২০১৯ সালের শুরুতেই রানাঘাটের পূর্ণনগর জগদীশ মেমোরিয়াল বৃদ্ধাশ্রমে নিজের জীবনের শেষ সময়টুকু কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছাতে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন সুব্রতবাবু।
এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও এতদিন অবিবাহিতই ছিলেন তিনি। এদিকে, বৃদ্ধাশ্রমে আসার পরেই সুব্রতবাবুর সঙ্গে দেখা হয় ৬৫ বছরের অপর্ণা চক্রবর্তীর। অপর্ণাদেবী ইতিমধ্যেই প্রায় ৫ বছর কাটিয়ে ফেলেছিলেন সেখানে। তাঁর বাড়ি ছিল রানাঘাটের আইসতলায়।
কাকতালীয় ব্যাপার, তিনিও এতদিন ধরে অবিবাহিতা ছিলেন। নিজের জীবনে প্রায় ৩০টি বছর কলকাতার বেলেঘাটায় এক অধ্যাপকের বাড়িতে তিনি পরিচারিকার কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন। তবে জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে বাপের বাড়ির দরজা নিজের জন্য বন্ধ পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত এই বৃদ্ধাশ্রমকেই বেছে নিতে হয়েছিল তাঁর।
এই বয়সে এসে বিয়ে করে এক আলাদাই আনন্দে আছেন তাঁরা দুজনে। তবে বৃদ্ধাশ্রমে দেখা হওয়ার পর থেকে বিয়ে পর্যন্ত এই রাস্তাটা এত মসৃণভাবে কাটেনি। বৃদ্ধাশ্রমে দুজনের দেখা হওয়ার পরে সুব্রতবাবু একপ্রকার প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যান অপর্ণা দেবীর। প্রথম দিকে তিনি তাঁর মনের কথা অপর্ণাদেবীকে জানালেও, তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। তারপরেই খানিক মন ভেঙে যায় সুব্রতবাবুর। এরপরে তিনি প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে আর সুপর্ণাদেবীর কাছে যাননি।
তারপরেই এলো ২০২০ সাল। মার্চ মাস নাগাদ সুব্রতবাবু বৃদ্ধাশ্রম ছেড়ে ওই এলাকাতেই একটি ঘর ভাড়া নিয়ে চলে যান সেখানে থাকতে। তাই আগের মতো আর দেখা অথবা কথাবার্তা হতো না দুজনের কারোর। তবে একদিন হঠাৎই নিজের ভাড়া বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন সুব্রতবাবু।
আর সেই খবর পাওয়া মাত্রই তাকে দেখভালের জন্য ছুটে আসেন বৃদ্ধা অপর্ণাদেবী। এখান থেকে আর পিছিয়ে যেতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত অভিভাবক হিসেবে তাঁরা বৃদ্ধাশ্রমের কর্ণধার গৌরহরি সরকারকে এই বিষয়টি জানিয়ে নিজেদের নতুন পথচলা শুরু করেন।
সুব্রত বাবু তাঁর বিয়ের অনুভূতি সম্পর্কে বলেন, 'এই বয়সে এসে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে আমি অনেক শান্তি পেলাম। অপর্ণাকে দেখার পরে প্রথম দিনেই ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। মনে-প্রানে চেয়েছিলাম ওর মতো একজন সাথীকে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে আনার। এখন ও আমার ঘরের লক্ষী। জীবনের শেষের দিকের বাকি দিনগুলো এভাবেই ওর সঙ্গে সুখে-শান্তিতে কাটিয়ে দিতে চাই।'
অপর্ণা দেবীর কাছে তাঁর অনুভূতির কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, 'প্রথমবার যখন ওঁর প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তখনই দেখেছিলাম ও নিজের চোখের জল আটকে রাখতে পারেনি। তখন খুব খারাপ লেগেছিল। তাই দ্বিতীয়বার ভাবলাম, এইভাবে আর মানুষটাকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। এখন আমি খুব খুশি। জীবনে এত কষ্টের পরে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।'
নিজেদের জীবনের এই শেষ অধ্যায়ে এসেও যে এভাবে দুজন মানুষ একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করতে পারেন, তা এই দুজনকে না দেখলে সহজে বিশ্বাস করা যায় না। বৃদ্ধাশ্রমের কর্ণধার গৌরহরি সরকার বলেন, 'শেষ পর্যন্ত আইনসম্মতভাবে তাঁদের বিয়ে দিতে পেরে আমি খুবই গর্বিত।' কেবল গৌরহরিবাবুই নয়, আনন্দিত গোটা বৃদ্ধাশ্রম এবং গোটা রানাঘাট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন