সম্পদ দে : বর্তমানে ব্যস্ততার জীবনে কেউই সম্পূর্ণ সুখী নন। কাজের চাপে, পরিবারের কথা চিন্তা করতে করতে শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছেগুলিকে পূরণ করা হয়ে ওঠে না অনেকেরই। বর্তমান সময়ে এই মানসিক বোঝা ও বেদনা নিয়েই জীবন কাটাচ্ছেন বহু মানুষ। অবসাদে ভুগছেন মহিলা থেকে পুরুষ সকলেই।
তবে এই তালিকায় আমরা প্রতিবার বাদ দিয়ে দিই এমন একটি বয়ককে, যাদের ভেতরে হয়তো কখনো কখনো একজন পরিণত মানুষের থেকেও বেশি বেদনা চাপা থাকে। অবসাদে ভোগে অন্য সকলের থেকে বেশি। কথা হচ্ছে শিশু এবং কিশোরদেরকে নিয়ে।
শিশুদের মন বুঝে উঠতে পারা মোটেও সহজ কাজ নয়। বড় মানুষদের মতো তাদের মন এত জটিল হয় না। তারা বড়ই সহজ সরল এবং সাদাসিধে হয়। সেই জন্যই কোনও খারাপ ঘটনা বা অভিজ্ঞতা তাদের মনে দাগ কাটে অনেক বেশি গভীরভাবে এবং তাড়াতাড়ি।
পরিণত মানুষদের কাছে তাদের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ থাকলেও শিশুদের কাছে মনের কথা ভাগ করে নেওয়ার মতো থাকে কেবলমাত্র তাদের বাবা-মা। তবে বর্তমানে এই ব্যস্ততার জীবনে বাবা মার কাছেও আজকাল সময় থাকে না তাঁর শিশুর মনের কথা জানার।
এমনকি পড়াশোনা এবং পরিবারের চাপের জন্য শিশুরাও নিজেদের ভেতরে চেপে রাখে তাদের সমস্যা। সেই জন্যই আজকাল ছোট ছোট শিশুদের ভেতরে ব্যাপক পরিমাণে দেখা দিচ্ছে অবসাদ। শিশুদের মনের ভাষা বোঝার জন্য তাদের মনের গভীরে যেতে হবে।
আর শিশু মনের সেই গহীন কোণে ঢুকতেই রায়দিঘির বকুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেওয়া হয়েছে এক অভিনব উদ্যোগ। স্কুলে চালু হয়েছে 'মনের কথা ড্রপবক্স'। ভাঙা ভাঙা হাতের লেখায় এক টুকরো কাগজে নিজেদের মনের গভীরের কথা লিখে সেই ড্রপবক্সে ফেলছে স্কুলের ছোট্ট ছোট্ট শিক্ষার্থীরা।
চিঠিতে লেখা শিশু মনের সেই কথাগুলো দেখার পরে রীতিমতো চমকে ওঠেন সমস্ত শিক্ষক থেকে শুরু করে অভিভাবকেরা। একটি চিরকুটে কেউ ভীষণ দুঃখ নিয়ে লিখেছে, 'বাবা-মা আমাকে ভালোবাসে না', একটি মেয়ে আবার লিখেছে, 'আমি নাচ শিখতে চাই, কিন্তু বাবা-মা শিখতে দিচ্ছে না'।
এব্যাপারে শিক্ষকেরা অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বললে অভিভাবকেরা জানান, নিজের মেয়েকে নাচ শেখানোর ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক অনটনের কারণে মেয়ের সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পারছেন না বাবা। ড্রপবক্স ভর্তি সেই ছোট্ট চিরকুটে লেখা মনের কথাগুলি দেখে শিক্ষক এবং অভিভাবকেরা অবাক এই ভেবে যে, এইটুকু মনেও কত অবসাদ এবং দুঃখ লুকিয়ে আছে।
অদ্ভুত বিষয়, নিজেদের মনের এই ইচ্ছেকে মনের ভেতরেই চেপে রেখে তারা কিভাবে প্রতিদিন স্কুলে এসে চুপচাপ পড়াশোনা করে যাচ্ছে। অভিভাবকদের দুঃখ এই ভেবেই যে, তাদের শিশুরা নিজের মনের কথা তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে ভাগ করে নিতে সাহস পায়নি।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিখিল সামন্ত জানান, স্কুলের তরফ থেকে এই প্রথমবার এইরকম একটি অভিনব উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেখানে কিনা শিশু মনের কথা জানার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরকে নিজেদের মনের ভেতরকার এমন কথা, যেগুলি কিনা তারা কোনদিন কাউকে জানায়নি, এমন কিছু কথা একটি চিরকুটে লিখে সেই ড্রপবক্সে ফেলতে বলা হয়।
তবে ড্রপবক্সে ফেলা সেই চিরকুটগুলি পড়ে বর্তমানে রীতিমতো হতভম্ব স্কুলের সমস্ত শিক্ষক। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জানান, তাঁরা যদি আগে বুঝতে পারতেন যে, এই ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের মনে এত অবসাদ জমে রয়েছে, তাহলে এই উদ্যোগ তাঁরা অনেক আগেই নিয়ে নিতেন।
তবে ইতিমধ্যেই স্কুলের তরফ থেকে সমস্ত ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদেরকে নিয়ে কাউন্সেলিং করানো শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে শিশু মনের এই অবসাদ সম্পূর্ণরূপে দূর করতে ভবিষ্যতে একজন মনোবিশেষজ্ঞকেও স্কুলে আনার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
তবে স্কুলে চালু করা এই অভিনব উদ্যোগ আমাদের প্রত্যেককে চোখে আঙুল দিয়ে এইটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, অবসাদে কেবলমাত্র বড় মানুষেরাই নন, ছোট ছোট শিশুরাও ভোগে। এমনকি বেশিরভাগ সময় তারা নিজেদের এই মানসিক বিষাদ কাউকে বলতেও পারে না। জমিয়ে রাখে নিজের মনে।
আর এইভাবে জমতে জমতেই একটি শিশু ধীরে ধীরে নিজের জীবনে অন্ধকারের দিকে এগোতে থাকে। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত, এখন থেকে আমাদের বাড়ির এবং আশপাশের শিশুদের সঙ্গে কথা বলা, তাদেরকে খেলতে দেওয়া, তাদের সঙ্গে খেলা করা এবং সময় নিয়ে তাদের সঙ্গে বসে তাদের মনের কথা জানা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন