প্রায় ১৫০ বছর ধরে চলার পরে শেষ পর্যন্ত যাত্রা সমাপ্ত করতে হলো আধুনিকীকরণের জন্য। হেরিটেজ এই ট্রেনটি চালানো হতো ওমকারেশ্বর রোড স্টেশন থেকে মহৌ পর্যন্ত। এই রুটটি ছিল মিটারগেজ লাইন। আর এই রুটটিকে মিটার গেজ থেকে ব্রড গেজে রূপান্তরিত করার জন্যই সমাপ্ত করতে হলো এই হেরিটেজ যাত্রা।
১২ টি জ্যোতির্লিঙ্গ পিঠের মধ্যে অন্যতম একটি সিদ্ধ পিঠ হল ওমকারেশ্বর। এদিকে, ওমকারেশ্বর থেকে যে মহৌ পর্যন্ত এই ট্রেন চলাচল করতো, সেই মহৌতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমাদের ভারতবর্ষের সংবিধানের রচয়িতা বাবা সাহেব আম্বেদকর।
১৫০ বছরের পুরনো এই রুটটি ছিল মিটারগেজের লাইন। মিটারগেজ হল সাধারণ লাইন বা ব্রডগেজ থেকে বেশ খানিকটা ছোট। ভারতবর্ষে মূলত তিন প্রকারের রেললাইন আছে। ব্রডগেজ, যা কিনা আমরা সাধারণত দেখে থাকি। তারপরে মিটারগেজ, এই লাইনটি ব্রডগেজ থেকে বেশ খানিকটা সরু হয়।
সবশেষে ন্যারো গেজ, সব থেকে সরু লাইন এটিই হয়ে থাকে। দার্জিলিং এর অন্যতম পরিচিতি টয়ট্রেন এই লাইনেই চলে। গত মঙ্গলবার হেরিটেজ এই মিটারগেজ ট্র্যাকে শেষ ট্রেন চালানোর আগে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যাত্রী এবং রেল কর্মীরা।
ওমকারেশ্বর এর বাসিন্দা এদিন বলেন, 'এই ট্রেনের শেষ যাত্রা দেখা আমার পক্ষে খুবই বেদনাদায়ক। একটা সময় ছিল যখন আমরা এই ট্রেনে করে খুব সহজেই ওমকারেশ্বর থেকে মহৌ বা বর্তমান যার নাম ডঃ আম্বেদকর নগর সেইখানে পৌঁছে যেতাম।'
শেষ যাত্রার আগে যাত্রীরা লোকো পাইলট এবং সহকর্মীকে মালা পরিয়ে সম্মান জানান। সেই সঙ্গে অনেকেই আবার ট্রেনের বগির গায়ে চক দিয়ে নিজেদের মনের আবেগপ্রবণ কথাগুলি লিখে রাখেন এই দিন। এই হেরিটেজ লাইনের শেষ যাত্রায় প্রায় ২০০ জন যাত্রী নিয়ে এই ট্রেন মঙ্গলবার দুপুর ১২:৪৫ নাগাদ মহৌতে পৌঁছায় শেষবারের মতো।
১৮৭০ সালে এই লাইনের কাজ শুরু হয়েছিল। তবে অত্যন্ত কঠিন যাত্রাপথের কারণে এর তৈরীর খরচ অনেকটাই বেড়ে যায়। ব্রিটিশ প্রশাসন সেই সময় এই প্রকল্পটি মাঝপথে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে হিন্দু পূর্ণার্থীরা ওমকারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ পিঠ পর্যন্ত যাতে সহজে যাতায়াত করতে পারেন, তারজন্য নিজেরা তহবিলে টাকা জমিয়ে তা ইংরেজ সরকারের হাতে তুলে দেন।
এমনকি তৎকালীন মহারাজ ১৮৭৩ সালে ৪.৫ শতাংশ সুদের হারে ১০১ বছরের জন্য ইংরেজ সরকারকে ১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলেন। তাঁদের রাজধানী ইন্দোরের সঙ্গে খান্ডওয়া শহরকে যুক্ত করার জন্য সেই সময় একটি লাইন স্থাপনের প্রয়োজন ছিল। সেই জন্যই ইংরেজদেরকে এই ঋণ দেওয়া হয়েছিল।
তবে মজার ব্যাপার হলো, সেই ঋণ এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ পরিশোধ করা হয়নি। টাকা সম্পূর্ণরূপে শোধ করার আগেই দেশ স্বাধীনতা পাওয়ায় ইংরেজরা টাকা শোধ না করেই দেশ ছেড়ে চলে যায়। এই রুটে খান্ডওয়া থেকে সানওয়াদ পর্যন্ত অংশটিতে ১৮৭৮ সালের ১ ডিসেম্বর কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে যাত্রী সমেত রেলের যাত্রা শুরু হয়।
রেলের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এই লাইনটি মূলত উত্তর ভারতকে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্যই এককালে ব্যবহার করা হতো। সরকারি সূত্র অনুযায়ী খবর, প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বাজেট ঠিক করা হয়েছে এই রুটটিকে ব্রডগেজে রূপান্তরিত করার জন্য।
কাজ ইতিমধ্যেই অনেকটা এগিয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই এই রুটেও চালু হতে চলেছে ব্রডগেজ লাইনের ট্রেন। তবে রেল কর্মী এবং এই রুটের যাত্রীদের দাবি, সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না করে হেরিটেজ এবং স্মৃতির জন্য বাঁচিয়ে রাখা হোক এই মিটারগেজ লাইন এবং ট্রেনকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন