নদীয়ায় কুম্ভমেলা
অজয় মজুমদার
দীর্ঘ ৭০৪ বছর পর বঙ্গ কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে নদীয়া জেলার কল্যাণী মাঝেরচর ভাগীরথীর তীরে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ঘাটে। ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ৫ দিন এই মেলা চলবে। সারা দেশ থেকে ২০০০ নাগা সন্ন্যাসী আসবেন বলে প্রচার চলছে, বাস্তবে এসেছেন শপাঁচেক বলেই মনে হয়। কারণ এলাকাটা সম্পূর্ণটাই ঘুরে দেখেছি৷ প্রচার আছে, তিন দিন ধরেই চলবে বিশ্বশান্তি যজ্ঞ, হেলিকপ্টার থেকে পুষ্প বর্ষনের ব্যবস্থাও আছে বলে কর্তৃপক্ষ জানাল।
উদ্বোধনের দিন আমি মেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলাম৷ বিভিন্ন স্টলের নাম্বারিং করা হয়েছে৷ মেলার প্রথম দিন ১০ শতাংশ দোকানও চালু হয়নি। কল্যাণী পিকনিক গার্ডেনের পাশ দিয়ে যে পাকা রাস্তা গঙ্গার দিকে গেছে, সেই রাস্তায় অন্তত ২.৫ কিলোমিটার গেলে তবেই মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছানো যাবে। এক কিলোমিটার পাকা রাস্তা আছে। তারপর ইটের এবং খোয়ার সরু রাস্তা।
এই রাস্তাটি প্রকৃতপক্ষে গঙ্গার চর। ওপারে ত্রিবেণী একটু এগুলেই মগরা। প্রথম দিন নাগা সাধুসহ ১০০ এর কাছাকাছি সাধুকে অনুষ্ঠান মঞ্চে তোলা হয়েছিল বিশ্বশান্তির বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে৷ কোনও ভিআইপিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। তবে অভিষেক ব্যানার্জির ছবি বুকে লাগানো ছিল বেশ কিছু যুবকের। কিছু স্বেচ্ছাসেবক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন৷ বেশ কিছু পুলিশের ডিউটি ছিল মেলা প্রীঙ্গনে৷
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মহাস্নান। এদিন প্রচুর জনসমাগম হয়। মেলা প্রাঙ্গণ পর্যন্ত যাওয়ার ভালো ব্যবস্থা নেই৷ বয়ষ্ক ধার্মিক মানুষদের যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই৷ ২.৫ কিলোমিটার হাঁটতেই হবে৷ এখন প্রশ্ন হল কুম্ভ মেলা কি ? এটি একটি হিন্দু উৎসব৷ এই উৎসবে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা তীর্থস্নান করতে আসেন৷ বিশ্বের বৃহত্তম শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হিসেবে এর রেকর্ড রয়েছে।
শ্রীশ্রী রামদাস কাঠিয়া বাবা মহারাজ 'ব্রজভূমির মহন্ত' এবং কুম্ভমেলার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের 'শ্রী মহন্ত' পদেত্ত আসীন ছিলেন৷ শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছিলেন, শ্রীশ্রী কাঠিয়া বাবা মহারাজ প্রাচীন যুগের গর্গ, নারদ ইত্যাদি মুনি ঋষিদের শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। তিনি কুম্ভ মেলার প্রেসিডেন্ট পদেও ছিলেন।
সাধারণ কুম্ভ মেলা চার বছর অন্তর আয়োজিত হয়৷ প্রতি ছয় বছর অন্তর হরিদ্বার ও প্রয়োগে (প্রয়াগরাজ) অর্ধ কুম্ভ আয়োজিত হয়৷ বারটি পুন্যকুম্ভ অর্থাৎ ১৪৪ বছর অন্তর প্রয়াগে আয়োজিত হয় মহাকুম্ভ। ২০০৭ সালে ৪৫ দিনব্যাপী সর্বশেষ অর্ধ কুম্ভ আয়োজিত হয়েছে। সাত কোটিরও বেশি হিন্দু তীর্থযাত্রী প্রয়োগের এই মেলায় যোগ দেন৷ ১৫ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তির দিন ৫০ লক্ষ মানুষ পুন্যস্নান করেন৷ ২০০১ সালে সর্বশেষ মহাকুম্ভে ছয় কোটি হিন্দু যোগ দিয়েছিলেন। এই দিনটিই ইতিহাসের বৃহত্তম জনসমাবেশ৷
কুম্ভমেলা চারিটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে আয়োজিত হয়৷ এই চারটি স্থান নির্বাচিত হয় বৃহস্পতি এবং সূর্যের অবস্থান অনুসারে৷এই কুম্ভমেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আরও এক বারুণীর মেলা, যা উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও একটা নির্দিষ্ট দিনে স্নানযাত্রা হয়৷ কল্যানীর ঘোষপাড়ায় সতীমার মেলাতেও পুন্য স্নানযাত্রা হয়।
নদীয়ার কুম্ভ মেলার স্নানযাত্রা ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। ভাগীরথীর চরে চলছে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু মানুষের সাদা কালো মাথা। একসঙ্গে এত ধর্মান্ধ মানুষ বা পুর্নার্থী দেখাটা সত্যি বিরল৷ ধর্মটা যদি সত্যি ধর্মের পথে চলে, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে– যুক্তিবাদী- মুক্তমনা হতে সাহায্য করে, তাহলে সমাজটাই সত্য যুগে পরিণত হবে। নাগা সাধুদের দেখলে বোঝা যায় জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে অহংকারকে জলাঞ্জলি দিয়ে এক অন্য জগতে বিচরণ করছেন৷ তাদের সংখ্যাও কম নয়।
নদীয়ার কুম্ভ মেলা কমিটি খুব ভালো ব্যবস্থা করতে পারেনি। গঙ্গাসাগরের মতো সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুব একটা চোখে পড়েনি৷ থাকার ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল না। সব থেকে বড় কথা অপ্রশস্থ স্থানে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ একটু প্রশস্থ স্থান খোঁজ করার প্রয়োজন ছিল৷ কেন এত মানুষ স্থানযাত্রা করেন, এর থেকে কি পান, সে বিষয়ে পুর্নার্থীদের প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। গঙ্গারচরে ইটভাটা রয়েছে। খুব একটা চাষ এখানে হয়না৷ এই মেলায় ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা খুবই কম৷
সব শেষে দুঃখের বিষয় হল, এত ভিড়ে ঠাসা মেলা প্রাঙ্গনের রাস্তায় মা শিশুকে কোলে নিয়ে যাবার সময় এক ধাক্কায় শিশুটি পাশের খালের জলে ছিটকে পড়ে সেখানেই শিশুটির মৃত্যু ঘটলো। এইরকম দুর্ঘটনা আরও বেশ কিছু ঘটছে মেলা চলাকালীন৷ কিছু মানুষ উন্মাদনায় পাগল হয়ে ওঠে৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন