সমকালীন প্রতিবেদন : বর্তমানে গোটা রাজ্য তথা দেশের যুবকদের জন্য একটি অন্যতম বড় সমস্যার নাম বেকারত্ব। সমস্যাটা ধীরে ধীরে এমন আকার ধারণ করছে যে, প্রচুর যুবক-যুবতীকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে অথবা ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালাতে হচ্ছে। আর এই সমস্যায় অন্যান্য সকলের থেকে সবথেকে বেশি ভুগছেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গাইঘাটা ব্লকের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ঝাউডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েত। এই পঞ্চায়েতেরই একটি এলাকা দাসপাড়া। এই গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দারাই দাস সম্প্রদায়ের। আর তাদের মধ্যেই একজন প্রসেনজিৎ দাস। গ্রামের দাস সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম গ্রাজুয়েট প্রসেনজিৎ।
গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ থেকে ২০২০ সালে গ্রাজুয়েট হয়েছেন তিনি। গোটা সম্প্রদায়ের প্রথম গ্রাজুয়েট হওয়ায় প্রসেনজিৎকে নিয়ে প্রথম প্রথম মেতে উঠেছিলেন গোটা এলাকাবাসী। তবে গ্র্যাজুয়েশনের সেই আনন্দ বেশিদিন টেকেনি। একের পর এক চাকরির চেষ্টা, পরীক্ষার পর পরীক্ষা, ইন্টারভিউ এইসব দেওয়ার পরেও কোনও চাকরি মেলেনি তাঁর।
শেষ পর্যন্ত গ্রাজুয়েট প্রসেনজিৎকে নিজের সংসার চালাতে বেছে নিতে হয়েছে পাকা রাস্তার ধারে বসে জুতো সেলাই করার কাজ। গ্রাজুয়েট হওয়া সত্ত্বেও জুতো সেলাই করতে হয় বলে কখনো কখনো মানসিকভাবে ভীষণ কষ্টে ভোগেন প্রসেনজিৎ। তবুও পরিবারের কথা চিন্তা করে কখনো কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার কথা মাথায় আসে নি তাঁর।
একটা সময় তাকে লোকের ভ্যান চালিয়ে এবং দিনমজুরের কাজ করেও কাটাতে হয়েছে। তবুও বাম আদর্শে বিশ্বাসী এই যুবক শাসক দলের সামনে মাথা ঝুকিয়ে উপার্জনের রাস্তায় হাঁটতে চাননি। নিজের শিরদাঁড়াকে বিক্রি করে দিতে চাননি কোনওমতেই। তাই হাজার কষ্ট হলেও এইভাবে সৎ পথেই উপার্জন করবেন বলে পন করেছেন তিনি।
প্রসেনজিতের কথায়, 'আজকাল চাকরি পেতে গেলে টাকা দিতে হয়। আমরা গরীব মানুষ। আমাদের কাছে অত টাকা নেই। আর থাকলেও দিতাম না। জুতো সেলাই করে দিনে খুব বেশি হলে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। প্রয়োজন পড়লে এইটুকুই আয় করব, কিন্তু অসৎ পথে যাবো না।'
প্রসেনজিতের বাবা কাঞ্চন দাস। তাঁর কাছে ছেলের এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে গলা ধরে আসে তাঁর। ছেলের বর্তমান এই অবস্থা দেখে যথেষ্টই কষ্ট হয় তাঁর। কাঞ্চনবাবু বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই প্রসেনজিৎ ভীষণ কর্মঠ।'
বাবা একা পেরে উঠতেন না বলে বাজারে গিয়ে বাবাকে সাহায্য করতেন প্রসেনজিৎ। সেই জন্য লোকের অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু সেই দিকে কান দেননি প্রসেনজিৎ। সংসারের দায়িত্ব সামলানোর জন্য একাধারে যেমন লোকের ভ্যান চালিয়েছেন, জমিতে গিয়ে পটল তুলেছেন, তেমনি স্কুলে এবং টিউশনিতে গিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন।
এভাবেই কষ্টের মধ্যে দিয়ে বিএ পাস করেছেন তিনি। তবে বর্তমানে বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় চাকরির আশা ছেড়ে শেষ পর্যন্ত হাটের ভেতর রাস্তার উপরে জুতো পালিশ এবং সেলাইয়ের কাজে নামতে হয়েছে তাঁকে। তবে কোথাও একটা দুঃখ থেকে গেছে প্রসেনজিতের বাবার মনে। তাঁর মতে, ছেলেটা একটা চাকরি পেলে গোটা সংসারটা সামলাতে তার একটু সুবিধা হতো।
স্থানীয় বাসিন্দারাও প্রসেনজিতের এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন। তাদের মতে, জীবনে সৎ নীতিকে আঁকড়ে রাখা একটি বড় ব্যাপার। প্রসেনজিতের পরিবার দরিদ্র হওয়া সত্বেও তারা তাদের এই নীতিকে ছেড়ে দেননি। আর সেটাই তাদের বামপন্থী ভাবনা-চিন্তা এবং লড়াইয়ের একটি বড় জয়।
বর্তমানে প্রসেনজিতের এই অবস্থা এবং তার লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই। তবে প্রসেনজিৎ একা নন, গোটা রাজ্য এবং দেশে এইরকম হাজার হাজার প্রসেনজিৎ আছেন, যারা কিনা উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পরেও মাত্র একটা চাকরির খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন