কোভালামে দুদিন
সুনীল কুমার রায়
মিয়ামির পরে বিশ্বে দ্বিতীয় অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সাজিয়ে রাখা কোভালম বীচে যাওয়ার পথে পুয়ার বোটিং সেন্টার। একটু দামাদামি করে দেড় ঘণ্টায় মাথাপিছু ৪০০ টাকার চুক্তিতে বোটে লাইভ জ্যাকেট পরে উঠলাম। একটি বোটে ছয়জন। চারিদিকে ঘন জঙ্গল, বিভিন্ন পাখির কলতান তার মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। অনেকটা সুন্দরবনের মতো। তবে সুন্দরবনে এতো কাছ থেকে জঙ্গলের স্বাদ পাওয়া যায় না। ওখানে দক্ষিণারায়ের শাসন।
রোমাঞ্চিত পথ। পথে দেখা জলপ্রপাত। চড়া দামে ভাড়া পাওয়া যায় কটেজ। ছোট ছোট দ্বীপে মেরি হাউস। প্রায় সবটাই খ্রিস্টীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভাষা মালায়ালম। সামনে বঙ্গোপসাগর। এখান থেকেই তিন কিলোমিটার দূরে আরব সাগর। এটাই কেরলের বৈশিষ্ট্য। এর মূল কারণ হলো খৃষ্টধর্মের প্রবর্তক যীশুর শিষ্য সেন্ট টমাস ৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসে প্রথম গীর্জা স্থাপন করেন কেরলে।
অন্যদিকে, কলোম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার এই কেরল বেড়িয়ে। আবার ইতিহাস বলছে, ঘাতকের হাত থেকে রক্ষা পেতে ক্লিওপেট্রা কেরলে ছেলে পাঠানো মনস্থির করেন। হোটেলে ফিরবার পথে কোভালাম বীচের কাছে ১২০ ফুট উচ্চতার শিব মূর্তি দেখলাম। শিল্প দক্ষতায় অসাধারণ। অনিন্দ্য সুন্দর, কাছেই সাগর। কুড়ি টাকা দর্শনীর মাধ্যমে এক শিল্পকলার মুখোমুখি হলাম।
একেবারে বঙ্গোপসাগরের কাছে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন হোটেল মেরিন প্লেসে উঠলাম। শান্তি ও নির্জনতা যারা ভালোবাসেন, তাদের কাছে তিরুভনন্তপুরম–কন্যাকুমারী সড়কে এক মুক্ত প্রকৃতির মাঝে আদর্শ স্বর্গীয়স্থান এটি। সমুদ্র এখানে গভীর অথচ শান্ত। আকারে ধনুকের মতো খাড়ির আকার ধারণ করেছে। একদিকে নীল সমুদ্র, আবার পাহাড়ি পরিবেশ, নারকেল, পেঁপে, কলার বিরাট বনষ্পতি। ছায়া বনবীথি।
১৯৩০ সালে এখানে প্রথম ইউরোপীয়রা এসেছিল। এরপর হিপিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। এখন পর্যটকদের জন্য এক অনবদ্য সানবাথের স্থান এখানে। মনোরম বীচ এই কোভালাম। এখানে রাজনীতির হঠকারীতা নেই, সবাই নিয়মে আবদ্ধ। বীচটিও চার টুকরো হয়েছে এখানে।
সমুদ্রগামী পথে convention centre, সমুদ্র পাড়ে madrasa hidyathul Islam, দক্ষিণে পপুলেট লাইট হাউস। বীচের চতুর্থ অংশ উত্তরে। এখানে আয়ুর্বেদিক প্রথায় নানা ব্যাধির উপশমে বহু ম্যাসেজ পার্লার আছে। এখানে এখনও জেলেরা নৌকা ভাসিয়ে মাছ ধরেন। বীচের কাছে অনেক হোটেল, কাফে, বেচাকেনার দোকান আছে।
এলাম পদ্মনাভপুরম মন্দিরে। কেরলের রাজধানী তিরুবন্তপুরমের ৫১ কিলোমিটার দক্ষিণ–পূর্বে তাক্কালির কাছে এই মন্দির। এটাই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মন্দির। ২০১১ সালে মন্দিরের অভ্যন্তরে এক অসাধারণ রত্নখনি আবিষ্কারের পর পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর আর কোথাও এক জায়গায় এতো স্বর্ণনির্মিত দ্রব্য পাওয়া যায় না। তিনি এই অর্থেই সম্পদের অধীশ্বর।
পদ্ম অর্থ কমল, নাভ অর্থ নাভি, পুরম মানে শহর। অর্থাৎ বিষ্ণুর নাভি থেকেই নির্গত এই পদ্মের শহর পদ্মনাভপুরম। কেরল এবং দ্রাবিড়ীয় মেলবন্ধনে এই মন্দির গঠিত। আঠারো শতকের মাঝামাঝি ত্রিভাঙ্কোরারের রাজা হন আনিঝাম থুরিনাম। ইনি মার্তন্ড ভার্মা হিসেবে পরিচিত। এই মন্দির দখল নিয়ে নবম দশক থেকেই চোর, পান্ড্য ও চেরাদের মধ্যে সংঘাত। ১৭৫০ সালে মাতন্ড ভার্মা এই রাজ্যটি পদ্মনাভস্বামীর পায়ে সমর্পণ করেন।
৬৫ একর কমপ্লেক্সে ১৪টি প্রাসাদ আছে। ভিআইপি মিটিং হল পুমুঘাম। এখানে ৯০ টি পদ্মফুলের আকারে মেহগনি কাঠের সিলিং আছে। ওনামাভিল্লুর দেওয়াল চিত্র এক কথায় অসাধারণ, অনবদ্য। পাথরের ভাস্কর্য চোখে পরার মত। মূল প্রবেশপথে পুরুষেরা শুধুমাত্র কাপড় পরে ভিতরে ঢুকতে পারবে।
দ্বিতলে দরবার হল, সুইমিং বাথ, ট্রেজারি, জেনানা মহল, বেলজিয়াম ও জলরঙের ১৬০০০ গোপিকাসহ শ্রীকৃষ্ণ, নাচঘর সহ একাধিক শিল্প সৌন্দর্যের অতুলনীয় সমাহার। প্রসাদের সামনে ৪৫টি প্যানেলে রামায়ণের আখ্যান, অসাধারণ। ৯০ রকম ফুলের নকশাকাটা ঠাকুরঘরে দেবতা বিষ্ণুর শয্যাটি কাঠের। নীচে মহারাজার অবস্থান। সব মিলিয়ে কোভলম অনবদ্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন