কন্যাকুমারীতে দু'দিন
সুনীল কুমার রায়
পনেরো বছরের মাথায় দ্বিতীয়বার কন্যাকুমারীতে এলাম। কন্যাকুমারী আমাদের কাছে এক আবেগ, ভারতের হৃদয়ের গভীরে। কন্যাকুমারীর ধূলিকণায় ভারত বিবেক বিবেকানন্দ আছেন, তাই আসা। উঠেছি বঙ্গোপসাগরের খুব কাছে হোটেল চিত্রায়। ডবল বেড পনেরশ, ব্যবস্থাপনা ভালো, জানলা খুললে সমুদ্র। দুপুরে কিছুক্ষনের জন্য হোটেলে বিশ্রাম করে বেড়িয়ে পরি। দেখা, একাত্মা হওয়া উদ্দেশ্য।
সী বীচের দিকে পথে পড়ে বিবেকানন্দ মিউজিয়াম। বিবেকানন্দের বাণী, একাধিক বিরল ব্যক্তিত্বের সাথে দেখা সহ বহু বিরল সংগ্রহ। ভালো লাগলো। একটু নীচে, আঠারটা সিঁড়ি। এগিয়ে গেলাম বীচের দিকে। শৃঙ্খলাবদ্ধ এলাকা, আকাশ মেঘলা। ফলে অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখা গেল না। হতাশ হয়ে চলে এলাম। গেলাম ওয়াক্স মিউজিয়ামে। প্রথমে অনিচ্ছুক ছিলাম সবাই। কিন্তু ভিতরে মোমের মূর্তি, অসাধারণ শিল্প সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে, বিস্মিত হই। মনে হয় সব জীবন্ত প্রতিমূর্তি। কবিগুরুর মূর্তি যথাযথ হয়নি। এটাই ব্যতিক্রম।
গেলাম ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির। অনেকটা তিরুপতি মন্দিরের অনুকরণে। এখানকার স্থাপত্যকলা, শিল্প চোখে পড়ার মতো। এলাম হনুমানজীর মন্দির। খুব প্রাচীন নয়। পুরো মন্দির অনেকটা জায়গা নিয়ে। সম্পূর্ন রামায়ণ পুরো দেওয়াল জুড়ে, বিস্মিত করা ছবির সাহায্যে বর্ণিত। অসাধারণ। বাইরে পাথরের উপরে হনুমানজীর মূর্তি। হোটেলে ফিরে, সাথী সতের জন আলোচনায় ভারী হলাম।
পরের দিন সকালে পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে (দুশো টাকারও ব্যবস্থা আছে) লঞ্চে বিবেকানন্দ রকে যাই। ১৮৯২ সালের ২৫ ডিসেম্বর উত্তাল সমুদ্র পার হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ৫৫ ফুট উঁচু শিলাখন্ডে ওঠেন। শান্তির অখন্ড বাণী উচ্চারণে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধ্যানে বসেন। অভিষ্ট সিদ্ধ হয়।
বাঁয়ে বঙ্গোপসাগর, ডাইনে আরব সাগর, সামনে ভারত মহাসাগর। প্রকৃতি এখানে অকৃপণ, শান্তির প্রগাঢ় পীঠস্থান। ভারত বিবেক বিবেকানন্দ পৃথিবীকে পথ দেখালেন। জলের রঙ পার্থক্য চিনিয়ে দেয়। মহীশূর থেকে আসা পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এখানে আত্মসমর্পণ করে মিশে গেছে। এখানে সাত রঙা বালি। পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। এই শিলা দুটির ব্যবধান ছিল ৬০ মিটার। এখন অনেক বেশি। অতীত নাম ছিল পিটরু মঠরু। বর্তমানে বিবেকানন্দ রক।
১৯৬৪ সালে বিবেকানন্দের জন্মশতবর্ষে এল এল সোলাভান্ডারের অসাধারণ ভাস্কর্যে স্বামিজীর আট ফুট উঁচু ব্রোঞ্জ মূর্তি নির্মিত হয়েছে। নীচে মেডিটেশন হল। সামনের শিলাখন্ডে কাঁচের আঁধারে কন্যাকুমারী দেবীর পায়ের ছাপ। অদুরে তামিল কবি তিরুভাল্লি ভারের বিশালাকার মূর্তি, পাথরের তৈরি হচ্ছে।
এলাম কন্যাকুমারীর আম্মান মন্দিরে। তিন সাগরের মেলবন্ধনে এক পুরানো মন্দির, ৭–৮ এর দশকে নির্মিত। মন্দিরের অভ্যন্তরে চারটি স্তম্ভ আছে। আঘাত করলে মৃদু বেণু, বীণা ও জলতরঙ্গের সপ্তস্বর প্রতিধ্বনিত হয়। তত্ত্বাবধায়কের জন্য দেখার সমস্যা। এখানে পুরুষদের খালি গায়ে ঢুকতে হয়। অপূর্ব শিল্পকলা, বিস্মিত হতে হয়।
অপূর্বা কন্যাকুমারী দেবী গ্রানাইট পাথরের উপরে দন্ডায়মান। নাকে পরশুরামের কাটা হীরার নখ, ডানহাতে জপমালা, বামহাত উরুর উপরে। দেবীর বিভিন্ন লগ্নে সাজ হয়। দেবীর নোলকের হীরা খন্ডের উজ্জ্বলতা গভীর সমুদ্র থেকে দেখা যায়।
সাধারণত এপ্রিল মাসে দেখা যায়। দেবী তিনটি শর্তে শিবকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন। সকালের আগেই চক্ষুহীন নারকেল, শিরহীন তাম্বুল, গ্রন্থিহীন ইক্ষু। কোনটাই সম্ভব হয়নি। তাই এখানে এগুলো দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। বীচে গান্ধী মন্ডপম।
১৯৫৬ সালে কন্যাকুমারী মন্দিরের উত্তর পশ্চিমে মহাত্মা গান্ধীর চিতাভস্ম বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। এখানকার শিল্প শৈলী এত অসাধারণ যে প্রতি বছর ২ অক্টোবর গান্ধীজির জন্মদিনে দুপুর বারোটায় সূর্য রশ্মি ছিদ্র পথে চিতাভস্মের উপর পড়ে। বিস্ময়কর। হোটেলে ফিরে এলাম।
খুবই উপভোগ্য বর্ণনা।
উত্তরমুছুন