আলেপ্পিতে সময় কাটিয়ে এলাম
সুনীল কুমার রায়
আলেপ্পির ডায়মন্ড রেসিডেন্সিতে উঠেছি। খুব ক্লান্ত। কিন্তু নতুনকে দেখার অধীর অপেক্ষায়। আলেপ্পির বর্তমান নাম আলপূজাহ। ala অর্থাৎ খাল ppuzha হচ্ছে নদী। অর্থাৎ সমুদ্রতল থেকে নীচে ৬৫ টি খাল মাকড়সার জালের মতো পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে বলেই নাম হয়েছে আলপূজাহ। একদিকে আরব সাগর অপর দিকে ব্যাক ওয়াটার একে অপরের মেলবন্ধনে সৃষ্ট এই জনপদকে বলা হয় আলপূজাহ। এই জনপদকে বলা হয় কেরলের ভেনিস অফ দি ইষ্ট।
খাল ও নদীপথে যাত্রী বা পণ্য পরিবহনের জন্য অসম্ভব মজবুত জলযানকে এখানে বলা হয় শালতি। প্রত্যেকটি শালতির গঠন দেখলে জলের গভীরতা অনুমান করা যায়। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিভঙ্কুর রাজার দেওয়ানের হাতে গড়া স্বপ্নের গ্রামীণ মনোভাবাপন্ন উন্নত জনপদ এটি।
সেই সময়ে আরব সাগরের জল খড়ি পথে এই নদীতে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গভীর বন, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের অসংখ্য বসতবাড়ি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এই জায়গাকে বলা হয় গ্রানারি অফ কেরল। গ্রামীণ অঞ্চল। পঞ্চায়েতের অধীনে। তবুও ভারতের যেকোনও বড় শহরকে আভিজাত্য ও শৃঙ্খলাবদ্ধতায় হারিয়ে দেবে।
যানবাহন নিয়ন্ত্রণে, শৃঙ্খলাবদ্ধ, অযথা হর্ণ বাজানো নিষিদ্ধ, কোনও রাজনৈতিক ছবি পোস্টার নেই, শাসক দলের প্রধানের ছবি বা পতাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না, এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা উল্লেখযোগ্য। ১৯ শতকে ব্রিটিশরা এই আলপূজাহকে পোতাশ্রয়ী নগরীর মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু বিশ শতকে কোচির প্রাধান্য সেই কৌলিন্য নষ্ট হয়।
এখানকার আর একটি অনবদ্য ও উল্লেখযোগ্য আকর্ষণীয় জলপথ, কেরলের বৃহত্তর ভেন্নানাদ লেক। আশি কিলোমিটার দীর্ঘ। আলপূজাহ থেকে শুরু করে তিন জেলা অতিক্রম করে কোচিতে আরব সাগরে মিশেছে। আমরা সতেরোজন দুই ঘণ্টায় সাত হাজার টাকার চুক্তিতে জলপথে ঘুরতে বের হলাম।
আমরা চলেছি পম্পা নদীর উপর দিয়ে। গভীরতা অনেক। প্রত্যেকটি বোট আকারে বড় এবং সুসজ্জিত। আসলে এই বোটে বেশি টাকা ভাড়া দিয়ে নদীর উপর রাত্রি যাপন, মধুচন্দ্রিমা পালন করবার সবরকমের ব্যবস্থা আছে। ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওরলাল নেহরুর হাত ধরে এই পম্পা নদীতে সূচনা হয়েছিল এক রোমহর্ষক বোট রেস।
আগষ্ট মাসের দ্বিতীয় শনিবার বিষাক্ত সাপ হুডে নিয়ে ঝলমলে সাজানো শতাধিক চন্দনভেলম নৌকায় আকর্ষণীয় প্রতিযোগিতা। এখনও চলছে। বিজেতা এক লাখ টাকার বেশি পায়। মালায়ালাম ভাষায় এই প্রতিযোগিতার নাম ভাল্লুম কালিম। মাথাপিছু দুশো টাকা দর্শনীর মাধ্যমে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটা অবধি কেরলের অন্যতম বৈশিষ্ট martial arts দেখার জন্য নির্দিষ্ট আসনে বসলাম।
বহু বিদেশি পর্যটকদের ভিড়। অনুষ্ঠানের শুরুতে দেহের বিভিন্ন কলাবিন্যাসে প্রায় তিন হাজার বছরের ঐতিহ্য martial arts এর দেবতাকে পূজা দিয়ে আরম্ভ করা হয়। অনুষ্ঠান গৃহের নাম kadathanadan centre. kadathanadan কথার উৎস প্রাচীনতম জায়গা kalaripayttu থেকে পাওয়া।
উনিশ শতকের ধারাবাহিকতায় তীর, ধনুক,বর্শা, তরোয়াল, খালি হাতের কৌশল অসাধারণ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেখিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছে। পাশেই কেরলের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ঘরণায় কথাকলি নৃত্য পরিবেশন। দর্শনী দুশো টাকা।
অনুষ্ঠানের শিরোনাম Navaram. ছৌ নাচের সজ্জায় এক সৃজনশীল উপস্থাপনা। অসাধারণ। ঘুরে বেড়ানো আমার নেশা। তবে আমার দেখা পঞ্চায়েতের অধীনে গ্রামীণ এই জনপদ, আলপূজাহ সার্বিক দিক থেকে অসাধারণ, অনবদ্য। উল্লেখযোগ্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন