সমকালীন প্রতিবেদন : একেই বলে মিরাকেল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে একসময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন বাবা। হ্যাম রেডিও এবং মিশনারিস অফ চ্যারিটির উদ্যোগে ২৩ বছর পর সেই বাবাকে ফিরে পেলেন তিন সন্তান। এতো বছর পর হারানো বাবাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আপ্লুত সন্তানেরা।
১৯৯৯ সালের সেই ভয়ঙ্কর সুপার সাইক্লোন মানুষের স্মৃতি থেকে অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উড়িষ্যার সমুদ্র উপকূলবর্তী একটি বড়ো অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেই ঝড়ের তাণ্ডবে, তার স্পষ্ট হিসাব এখনও নেই। সেই ঝড়ের মধ্যেই আরও হাজার মানুষের মত নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন পুরী জেলার নিমপদা থানা এলাকার বাসিন্দা কৃতিচন্দ্র বরেল।
তার পর থেকে নিখোঁজই থেকে গিয়েছিলেন। কেউ তাঁর কোনও হদিশ পায়নি। স্বাভাবিক নিয়মেই পরিবারের লোকজন থেকে শুরু করে প্রশাসন ধরেই নিয়েছিলেন, সুপার সাইক্লোনের বলি হয়েছেন কৃতিচন্দ্র। সরকারি নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময় পরে প্রশাসন কৃতিচন্দ্রকে মৃত বলে ঘোষণাও করে দেয়। কিন্তু কথায় আছে, 'রাখে হরি মারে কে'। অবিশ্বাস্যভাবেই সেই 'মৃত' কৃতিচন্দ্র ফিরে এলেন সন্তানদের কাছে। তবে তাঁর স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত।
জানা যাচ্ছে, সমুদ্র সৈকত থেকে হারিয়ে যাওয়ার পরে বাবার খোঁজে তার ছেলেরা গোটা রাজ্য চষে ফেলেছিলেন। বাবাকে ফিরে পেয়ে বড়ো ছেলে শেষদেবা বলেন, 'বাবার কোনও খোঁজ না পেয়ে আমরা তিন ভাই ধরে নিয়েছিলাম, তুফানের তোড়ে বাবা সমুদ্রে তলিয়ে গিয়েছেন।' বঙ্গোপসাগরের সৈকতে থাকা নিমপদার মতো আরও এলাকার বহু মানুষই ওই তুফানে তলিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কৃতিচন্দ্রের ভাগ্যের চাকা ঘুরেছিল অন্যদিকে।
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, দুর্যোগের পরে নিমপদা গ্রাম থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে সেই বঙ্গোপসাগরের তীরেই বিশাখাপত্তনমের রাস্তায় এক অসুস্থ প্রৌঢ়কে দেখতে পান সেখানকার মিশনারিজ অফ চ্যারিটির এক সদস্য। অসুস্থ প্রৌঢ়কে এর পর থেকে নিয়মিত খাবার দিত ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ফুটপাতবাসী ওই প্রৌঢ়র অসুস্থতা বাড়ায় তাঁকে নিজেদের আশ্রয়ে নিয়ে আসে ওই সংস্থা। দেখা যায়, ওই ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। নিজের পরিচয়ও বিস্মৃত। সুপার সাইক্লোনের প্রায় ২৩ বছর পর থেকে তিনি ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আশ্রয়ে রয়েছেন অজ্ঞাতপরিচয় হিসাবে।
তারপর ঘটে মিরাকেল। অবশ্য এই ক্ষেত্রে ওই মিশনারি ও হ্যাম রেডিওর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ফাদার বলেন, ওই ব্যক্তি যে কখনও তার স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবেন, তাঁরা সেই আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। এর মধ্যেই একদিন ওই বৃদ্ধ নিজের মনে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলামের একটি গ্রামের নাম বলতে থাকেন।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ধারণা হয় বৃদ্ধ হয়তো ওই গ্রামের বাসিন্দা। তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বৃদ্ধ নিজেও জায়গাটা চিনতে পারেন না। এলাকার মানুষও বৃদ্ধকে চিনতে ব্যর্থ হন। ফের বিশাখাপত্তনমে ফিরিয়ে আনা হয় বৃদ্ধকে। সম্প্রতি ওড়িয়া ভাষায় নিজের মনেই কথা বলতে শুরু করেন ওই বৃদ্ধ। তার পরেই রহস্যের সমাধানে এগিয়ে আসে হ্যাম রেডিও।
এবার ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় হ্যাম রেডিও এবং ওয়েস্টবেঙ্গল রেডিও ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগবিশ্বাসের সঙ্গে। তাঁরা ফোনে কথা বলা শুরু করেন ওই বৃদ্ধের সঙ্গে। অসংলগ্ন কথার মধ্যেই বৃদ্ধের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে কয়েকটি জায়গার নাম।
ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবের সদস্যরা তাঁদের ওড়িশার সদস্যের মাধ্যমে খোঁজ শুরু করেন ওই গ্রামগুলোতে। শেষ পর্যন্ত বামানালা-পাতিগ্রামের কয়েকজন ওই বৃদ্ধকে শনাক্ত করেন ২৩ বছর আগে মৃত কৃতিচন্দ্র হিসাবে। অম্বরীশ বলেন, ‘আমরা সঙ্গে সঙ্গে কৃতিচন্দ্রের বাড়িতে যোগাযোগ করি। তাঁর তিন ছেলে। তাঁরাও ছবি দেখে বাবাকে চিনতে পারেন। বাবাকে চিনতে পেরে তাঁরা উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন।
এর পরেই ওখান থেকে ওই বৃদ্ধকে নিয়ে আসা হয় তার গ্রামে। তিন ছেলেই চিনতে পারেন বাবাকে। গ্রামের অনেকেই বৃদ্ধকে সনাক্ত করেন। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বৃদ্ধের বড় ছেলের হাতে বাবাকে দিয়ে খুশিতে ফিরে যায় আবার নিজেদের সংস্থায়। আর ছেলেরা পরম যত্নে বাবাকে ঘরে নিয়ে যান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন