আমরা এখন সোমনাথ ও ভালুকাতীর্থে
অজয় মজুমদার
১৮ অক্টোবর ২০২২ সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ দ্বারকা থেকে আমরা সোমনাথের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দূরত্ব ২৩৩ কিলোমিটার৷ পথে যেতে যেতে অনেক মন্দির ও দর্শনীয় স্থান দেখলাম৷ আমাদের গাড়ি এসে থামলো ভালুকা তীর্থে৷ একটা বিশাল ইসকনের গেটের মধ্যে দিয়ে আমরা মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তীর বিদ্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পুরানের কাহিনী অনুযায়ী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর মৃত আত্মীয়-স্বজনদের হারানোর শোকে গান্ধারী পাগলের মত শ্রীকৃষ্ণের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন এবং এই যুদ্ধে তিনি সরাসারি শ্রীকৃষ্ণকে দায়ী করেন৷ কৃষ্ণ চাইলে এই যুদ্ধ আটকাতে পারতেন৷ কিন্তু কৃষ্ণ এই বিষয়ে বারবার বলেন, আমি এই যুদ্ধে কৌরব ও পান্ডবদের নিরস্ত্র হতে বলেছিলাম। কিন্তু দুর্যোধন শোনেননি৷ গান্ধারী তখন শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ দেন– 'আমার মতো তোমারও যদু বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।' এই অভিশাপ শ্রীকৃষ্ণ মাথা পেতে নেন।
একদিন ভালুকায় শ্রীকৃষ্ণ গাছের নিচে বিশ্রাম করছিলেন৷ ঠিক সেই সমর জরা নামক একটি ব্যাধ শ্রীকৃষ্ণের পদ যুগলকে হরিনের শিং ভেবে তীর ছোড়ে। সেই তীরের ফলার বিষে আক্রান্ত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেহত্যাগ করেন৷ বুঝতে পেরে শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়ে জরা ক্ষমা চান। শ্রীকৃষ্ণ জানান, এতে তার কোনও দোষ নেই৷ এতেই বোঝা যায়, ভগবান কতটা ক্ষমা করতে পারেন৷
প্রভু যীশুর ক্ষেত্রেও একই রকম দেখা গেছে৷ যখন তার পায়ে পেরেক বিদ্ধ করা হচ্ছে, তখন তিনি বলছেন, ঈশ্বর ওরা অবুঝ, ওদের অপরাধ ক্ষমা কর। মন্দিরটি বেশ সুন্দর। আমরা চারদিক ঘুরে দেখলাম৷ মনে হল আমরা এখনো পৌরাণিক যুগে হেঁটে বেড়াচ্ছি। বেলা তিনটে নাগাদ আমরা পৌছালাম সোমনাথ হোটেলে। এটি জুনাগড় হাইওয়েতে অবস্থিত৷
বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম ত্রিবেণী সঙ্গমের দিকে৷ এখানে আরব সাগরের সঙ্গে তিনটি নদীর সঙ্গম ঘটে৷ নদীগুলির নাম হল- হিরন, কপিলা এবং সরস্বতী৷ হিরন ও কপিলা দেখা গেলেও সরস্বতী এখানে অন্তরসলিলা বলে বিশ্বাস করা হয়৷
এই সঙ্গমে স্নান করা খুবই পবিত্র বলে অনেক হিন্দু মনে করেন। লক্ষী, নারায়ণ এবং গীতা মন্দির কাছাকাছি অবস্থিত।এগুলি ধর্মীয় স্থান হলেও রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি রয়েছে। ওখানে ডিজেল বোটে করে সঙ্গমের শেষ পর্যন্ত যাওয়া যায়। জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়া। আমরা সঙ্গমের শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলাম।
একদম কালচে নীল রং এবং পরিষ্কার ঝকঝকে জল। বেশ গরম ছিল, স্নান করতে ইচ্ছে করছিল৷ বোটে একজন গাইড ছিলেন তিনি লেকচার দিচ্ছিলেন৷ কিন্তু মনটা প্রকৃতির দিকেই পড়েছিল৷ এবার আমরা গেলাম সোমনাথ মন্দিরে৷ মেয়েদের এবং ছেলেদের পৃথক লাইন৷ ব্যাগ, ক্যামেরা, মোবাইল ফোন এবং ডিজিটাল ঘড়ি সব বাইরে রেখে যেতে হবে।
সোমনাথ মন্দির ভারতের একটি প্রসিদ্ধ শিব মন্দির। গুজরাট রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের বেরাবলের নিকটে প্রভাস ক্ষেত্রে এই মন্দির অবস্থিত৷ সোমনাথ শব্দটির অর্থ চন্দ্র দেবতার রক্ষাকর্তা৷ মন্দিরটি চিরন্তর পীঠ নামে পরিচিত। কারণ অতীতে ৬ বার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মন্দিরটি তাড়াতাড়ি পুনর্গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে নভেম্বরে জুনাগরে ভারত ভুক্তির সময় এই অঞ্চল পরিদর্শন করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহন করেন৷
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দক্ষ প্রজাপতি কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে চন্দ্র প্রভাস তীর্থ শিবের আরাধনা করলে, শিব তার অভিশাপ অংশ নির্মূল করেন। এই কারনে চন্দ্র সোমনাথে শিবের একটি স্বর্ণ মন্দির স্থাপন করেন। পরে রাবণ রৌপ্য ও কৃষ্ণ চন্দন কাঠ দ্বারা মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস৷
একাধিক মুসলিম আক্রমণকারী এবং শাসকদের দ্বারা বারবার ধ্বংসের পরে মন্দিরটি অতীতে বেশ কয়েকবার পুনর্গঠিত করা হয়েছিল৷ সোমনাথ মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে আরব সাগর i রাত হলেও মন্দির চারপাশটা ঘুরে দেখেছিলাম কারণ দলের মহিলাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ওদের সঙ্গে দেখা হলে এক সঙ্গে আমরা আবার সোমনাথ হোটেলে ফিরে যাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন