ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকার পথে
অজয় মজুমদার
আজ সকালে উঠে রেডি হয়ে সবাই ডাইনিং এ এলো। চাউমিন, চা খেয়ে আমরা সবাই গাড়িতে উঠলাম। আজ ভুজ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে, যেতে হবে দ্বারকায়৷ দূরত্ব ৪০৩.৬ কি.মি। আমরা যাচ্ছি ১৫১ এ ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে। মোটামুটি সারাদিনের বাস জার্নি৷ রাস্তার দুপাশে নারকেলের চাষ৷ ছোট ছোট গাছের প্রচুর নারকেল ফলে রয়েছে৷ এখানে প্রচুর তুলো চাষ হয় এই জন্যই হয়তো বস্ত্র শিল্পে গুজরাট এত উন্নত। আমাদের রবিদা প্রচুর আপেল এবং লেবু নিয়ে বাসে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই বড় বড় আপেল কেটে সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার স্বপন তো পরপর খেয়ে যাচ্ছে৷ কোনও না নেই।
এবার আমরা পৌছালাম একটা ধাবায়। আমাদের নিজেদের রান্না খাবার সুকুমার, অজয় সার্ভ করলো। দই সহযোগে সুন্দর করে লাঞ্চটা সারলাম। আমাদের গাড়ির এসিটা খারাপ হয়েছে। মেরামত করতে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগলো৷ সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমরা পৌছলাম দ্বারকায়৷ উঠলাম হোটেল নিলয় এ৷ এটি নারায়ণ পেট্রোল পাম্পের পাশে। এতদূর জার্নি করে সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে৷ রাতে বিশেষ মেনু ছিল ভেটকি মাছের পাতুরি৷ দ্বারকা হলে কি হবে এখানে কিন্তু মাছ মাংস খাওয়ার চল আছে। এটা বেশ আশ্চর্য লাগল। অথচ এর আগে আমরা যখন ভুজে ছিলাম, সেখানে কিন্তু নিরামিষ খেতে হয়েছিল।
পরদিন সকাল ৮টা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়ি ভেট দ্বারকার উদ্দেশ্যে। রাস্তায় আমাদের গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম কিছু মন্দির তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গণেশ, শিব, কেশব রাজ, সত্যভামা, রুঙ্কিনী মন্দির। কিছু দূর পরে দেখলাম নাগেশ্বর মন্দির। গুজরাট রাজ্যটি মন্দির, মসজিদ পরিবেষ্ঠিত৷ ভেট দ্বারকা বা শঙ্খধর হল কচ্ছ উপসাগরের মুখে একটি জনবসতিপূর্ণ দ্বীপ৷ যা ভারতের গুজরাট. ওখার উপকূল থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত৷ উত্তর–পশ্চিম থেকে দক্ষিণ–পূর্ব দ্বীপটি ১৩ কিলোমিটার লম্বা, আর চওড়া ৪ কিলোমিটার।
এই দ্বীপটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদি বাসস্থান বলে মানুষের বিশ্বাস৷ মন্দির প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব গুরু বল্লভাচার্যের৷ মন্দির ছাড়াও, কমপ্লেক্সের অন্যরা হনুমান, বিষ্ণু, শিব, লক্ষ্মী, নারায়ণ, জাম্ববতী দেবী এবং অন্যান্যদের স্মরণ করে। 'ভেট' শব্দটির অর্থ হল- উপহার৷ মানুষের বিশ্বাস যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এটি তার বন্ধু সুদাম-র কাছ থেকে পেয়েছিলেন৷ প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতে ভেট দ্বারকা 'অন্তদ্বীপ' নামে পরিচিত৷ সেখানে যাদব বংশের লোকেদের নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। জন্মাষ্টমীর সময় অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে এখানে সবকিছু পালিত হয়৷
ওখা থেকে ভেট দ্বারকা সংযোগকারী একটি সমুদ্র সেতুর ভিত্তি ২০১৭ সালে স্থাপন করা হয়েছে৷ ভেট দ্বারকা শ্রীকৃষ্ণের শাসনের অধীনে ছিল। এখানেই তাঁর প্রকৃত আবাসিকস্থল ছিল৷ স্বাধীনতার পরে অঞ্চলটি তার প্রকৃত শাসকদের দ্বারা পুনরুদ্ধার করা হয়। স্বাধীনতার পরে অঞ্চলটি সৌরাষ্ট্র রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে। যা পরে বম্বে রাজ্যের সাথে মিশে যায়৷ কৃষ্ণের প্রভু তার পরিবারের সঙ্গে ভেট দ্বারকায় থাকতেন৷ স্বাধীনতার পরে এই অঞ্চলটি তার প্রকৃত শাসকদের দ্বারা পুনরুদ্ধার করা হয়। বম্বে রাজ্য থেকে গুজরাট রাজ্য তৈরি হলে, ভেট দ্বারকা গুজরাটের জামনগর জেলার অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ভেট দ্বারকা সর্বদাই প্রত্নতাত্ত্বিক কৌতুহল জাগিয়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওসানোগ্রাফির সামুদ্রিক প্রত্নতত্ত্ব কেন্দ্র ১৯৮১ থেকে ১৯৯৪ সালের দিকে ভেট দ্বারকার তীরে অনুসন্ধান চালিয়ে মাটির পাত্র, বেশ কিছু শিল্পকর্মের অবশেষ পাওয়া গেছে৷ এগুলি হরপ্পা যুগের বলে মনে করা হয়। পাথরের নোঙর এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের অবশেষও পাওয়া যায়। ফলে মনে করা হয়, রোমান সাম্রাজ্যের সাথে উন্নত বাণিজ্যের যোগাযোগ ছিল।
দুপুর দুটো৷ আমরা ফিরে এলাম হোটেল নিলয় -এ। লাঞ্চ সেরে আবার সাড়ে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। আজকের লাঞ্চে উল্লেখযোগ্য মেনু হলো ভেটকি মাছের পাতুরি৷ অসাধারণ তার টেস্ট৷ খাওয়ার পর বিশ্রাম করা গেল না৷ আমরা হোটেল নিলয় থেকে হেঁটে দ্বারকা মন্দিরের গেলাম। গুজরাট রাজ্যের দেবভূমি দ্বারকা জেলায় দ্বারকা মন্দির অবস্থিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে চারধাম নামে পরিচিত৷ চার প্রধান তীর্থস্থানের একটি হলো দ্বারকা৷ হিন্দু শাস্ত্রে দ্বারকাকে শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী বলা হয়।
ভাগবত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীন রাজ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে৷ বিশ্বাস করা হয় যে, এটি গুজরাটের প্রথম রাজধানী ছিল৷ দ্বারকা ভারতের সাতটি প্রাচীন ধর্মীয় শহরগুলির মধ্যে একটি (সপ্তপুরী)৷ শহরের নামের আক্ষরিক অর্থ হল- প্রবেশদ্বার। দ্বারকাকে ইতিহাস জুড়ে মোক্ষপুরী দ্বারোকামতি এবং দ্বারকাবতী নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কিংবদন্তি অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় তার মামা কংসকে পরাজিত করে হত্যা করার পর এখানে বসতি স্থাপন করেন৷ মথুরা থেকে দ্বারকায় কৃষ্ণের অভিবাসনের এই পৌরাণিক বিবরণ গুজরাটের সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত৷
দ্বারকা তৈরি করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ সমুদ্র থেকে ১২ যোজন বা ৯৬ বর্গ কিলোমিটার জমি পুনরুদ্ধার করেছিলেন বলেও বর্ণিত আছে। দ্বারকার রাজত্বের বেশিরভাগ পর্যটন থেকে প্রাপ্ত হয়৷ কারণ এটি তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি পূর্ণ স্থান৷ দ্বারকার মন্দিরটি পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের আরব সাগরের মুখোমুখি কচ্ছ উপসাগরের মুখে গোমতী নদীর ডান তীরে ওখা মন্ডল উপদ্বীপের পশ্চিম তীরে অবস্থিত৷ ৭২ টি স্তম্ভ দ্বারা নির্মিত পাঁচতলা ভবনটি প্রধান মন্দির হিসেবে পরিচিত। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুশীলন অনুযায়ী আদি মন্দিরটি ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথমদিকে নির্মিত হয়েছিল৷ মন্দিরটি ১৫-১৬ শতকে পুনর্নির্মিত এবং বড় করা হয়েছিল৷ দ্বারকা মন্দির ক্যাম্পাসের মধ্যেই শঙ্করাচার্যের মন্দির।
আদি শংকরাচার্য (৭৮৮ – ৮২০) ছিলেন একজন দার্শনিক। 'অদ্বৈত বেদান্ত' নামে হিন্দু দর্শনের যে শাখাটি আছে, তিনি ছিলেন সেই শাখার একজন প্রবক্তা৷ সারা ভারত ঘুরে ঘুরে তিনি তাঁর মত প্রকাশ করেছিলেন৷ হিন্দু ধর্মকে পথ নির্দেশ দেওয়ার জন্য ভারতের চার প্রান্তে স্থাপন করেন চারখানি মঠ। এই মঠ গুলি হল– শৃঙ্গেরী(কর্ণাটক), দ্বারকা (গুজরাট), পুরী (ওড়িশা), জ্যোতির্ময় বা জ্যোতির্ময় মঠ (উওরাখন্ড)। আমরা এই মঠও দেখলাম।
আমরা যখন গোমতীর তীরে এলাম তখন অন্ধকার সবে নেমেছে। একটা দোকানে ঘন গরম দুধ ও সর বিক্রি হচ্ছে। আমরা কিনে খেলাম৷ গোমতী নদীর পাড় সম্পূর্ণ ঘেরা৷ রাতের অন্ধকারে ভালো করে দেখতে পেলাম না। এবার হেঁটে হেঁটে আমরা চলে গেলাম আমাদের নিলয় হোটেলে। আজ রাতের মেনু ছিল বেশ জমকালো। মটন বিরিয়ানি এবং চিকেন চাপ৷ এই সমস্ত আহারের পরে ঠান্ডা পানীয় সেবন করে যে যার ঘরে ঘুমতে গেলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন