ভুজের মাধাপার গ্রাম
অজয় মজুমদার
১৪ অক্টোবর ২০২২ সকালে ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমাদের লাগেজ গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। সঙ্গে দুপুরে রান্না করা খাবারও। সকাল ৮.৩০ আমাদের যেতে হবে আমেদাবাদ থেকে ভুজ। দূরত্ব ৩৩৪ কিলোমিটার। আমাদের গাড়ি মানেই এক পরিবার৷ বসা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। সামনের সিটে একদিন বসলে পরের দিন তার পেছনের সিটে বসতে হতো। আবার একেবারে পেছনের সিটের মানুষেরা একটা করে এগিয়ে আসবে। এ সব নির্দেশই ডা: সাহারুনের।
আড্ডা গল্প সবই চলছে৷ মাঝেমধ্যেই কেউ না কেউ চকলেট দিয়ে যাচ্ছে। সানুকে নিয়ে সবাই টানাটানি করছে৷ তারমধ্যে ছোটখাটো অনুষ্ঠান চলছে। রাস্তার দু'ধারে কল কলকারখানা আর ফাঁকা জায়গাগুলিতে নারকেলের জঙ্গল৷ এত সুন্দর নারকেলের চাষ কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না৷ আর মাঝে মাঝে আছে বড় বড় খাটাল৷ তবে বেশির ভাগই রুক্ষ, সবুজের সমাবেশ কম।
যেতে যেতে আমরা নামলাম বন্দেমাতরম মেমোরিয়ালে। এটি ভুজেই অবস্থিত৷ ১৮৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন থেকে আমাদের দেশের স্বাধীনতার যাত্রাকে অমর করবার জন্য নিবেদিত। এই মেমোরিয়ালটি গুজরাটের ভুজ অঞ্চলে ১২ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত। সেখানে একটি সংসদ ভবন, ইন্ডিয়া গেট, হলুদ দুর্গা এবং সকলের উপভোগের জন্য খোলা মাঠ রয়েছে। মাঠের একটি অংশে হীরালক্ষ্মী ক্রাফট পার্কও রয়েছে। সম্পূর্ণ মিউজিয়ামটি আশাপুরা ফাউন্ডেশন এর অলাভজনক উদ্যোগ৷
কচ্ছ এবং ভুজের গ্রাম জুড়ে স্থানীয় কারিগরদের বাস। তাদের ক্রেতাদের কাছে তাদের কারু শিল্প প্রদর্শনের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছে৷ প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা। এটি একটি জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ৷ গান্ধী জীবনের উপর ভিক্তি করে একটি আকর্ষণীয় জাদুঘর রয়েছে৷ বাগানে চরকাসহ গান্ধীজীর মূর্তি রয়েছে৷ সবাই বেশ ক্লান্ত। কবিগুরুর সেই লাইনটি মনে পড়ছে- ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু -(দিজ ওয়ারিনেস ফর গিভ মি ও মাই লর্ড)৷
ফিরে এলাম মিউজিয়াম থেকে। ফাঁকা জমির একটি অংশে রয়েছে পরিখা। তার উপর দিয়ে ব্রিজ। প্রচুর হাঁস পালন হয় এখানে৷ দল দল হাঁস জলে সাঁতার কাটছে আনন্দে। একসঙ্গে অন্তত ৫০ টি হাঁসের ছবি তোলা হলো। নানা রং-এর পাখিও এখানে হজির হয়েছে৷ কি প্রাণবন্ত ওরা। আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ আমরাও খুশিতে মশগুল। রবিদা তো বৌদির সঙ্গে বারবার ছবি তুলছে৷ আমাকে ছবি তুলে দিতে বলছে৷ এখানে স্বপন লাগামছাড়া হয়ে ঘোড়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবারই বেশ আনন্দে কাটছে বলে মনে হল।
বন্দেমাতরম মিউজিয়াম থেকে এরপর গ্রামে ফিরে এলাম। পথে আসতে আসতে দেখলাম প্রচুর খাটাল৷ দুধের কোনও অভাব নেই৷ এবার একটি ধাবায় এসে আমাদের তৈরি করা খাবার খেয়ে নিলাম৷ ওখানকার খাট্টা দই কিনে খেলাম। নিরামিষ খাবার খিদে পেটে ভালোই লাগলো। বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম হোটেল তুলসীতে৷ এটি ভুজ-আনজার হাইওয়ের উপর অবস্থিত। ভিপুল পেট্রোল পাম্পের সামনে৷ সবাই খুব ক্লান্ত, সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে রাতে।
১৫ অক্টোবর ২০২২। ভোর পাঁচটায় উঠলাম। তখনও চারিদিক অন্ধকার। এত সকালে কোথাও যাওয়া যাবে না। রবিদা কে বললাম। স্বপন যেতে চাইলো না৷ সকালে একটা গ্রামে যাব। গ্রামের নাম মাধাপার৷ এটি ভারতের গুজরাট রাজ্যের কচ্ছ জেলায় অবস্থিত একটি গ্রাম। আমাদের তুলসী হোটেল থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে। গ্রামে প্রায় ৭৬০০ পরিবার এবং ২০০০ কোটি ভারতীয় টাকা মূল্যের ব্যাংক আমানত রয়েছে৷
মাধাপার হল কচ্ছের মিস্ত্রীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ১৮ টি গ্রামের মধ্যে একটি৷ দ্বাদশ শতাব্দীতে কচ্ছ- গুর্জর ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত একটি সম্প্রদায়ের অনেক লোক ধনেটি নামের একটি গ্রামে চলে আসে৷ পরে আঞ্জার ও ভুজের মধ্যে বসতি স্থাপন করে। মাধাপারের নামকরণ করা হয়েছে মাধ-কাঞ্জি সোলাঙ্কির নাম অনুসারে৷ যিনি ধনেটি গ্রাম থেকে মাধাপারে এসেছিলেন। মাধ-কাঞ্জি ছিলেন গুজরাটের সোলাঙ্কি রাজ বংশের হেমরাজ হরিদাসের তৃতীয় প্রজন্ম৷ ১৮৬৪ সালে প্রথম সরকারি বালক বিদ্যালয় চালু হয়। মিস্ত্রি সম্প্রদায়ের ভীমজী দেবজী রাঠোর ১৯০০ সালে মাধাপারে প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন৷ মাধাপার সরস্বতী উচ্চ মাধ্যমিক ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বর্তমান সময়ে শহরটি আরও সবুজ হয়ে উঠেছে৷ নতুন হ্রদ, চেক ড্যাম এবং গভীর বোর আর্টিশিয়াম কূপ, যা সারা বছর বিশুদ্ধ জল সরবরাহ করে৷ নতুন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, খেলার মাঠ, পার্ক ও মন্দির রয়েছে। মাধাপারে দুটি বড় হ্রদ রয়েছে। একটির নাম জলসাগর৷ এটি নির্মিত হয়েছে ১৯০০ সালে৷ অপরটি মেঘ রাজি হ্রদ৷ কচ্ছ রাজ্যের শেষ শাসক মেঘরাজীর নামে৷ মাধাপারে রয়েছে সনাতন ঠাকুর মন্দির, মহাদেব মন্দির, বিড়লা মন্দির এবং স্বামীনারায়ণ মন্দির (১৯৪৯)।
এই অঞ্চলের (মাধাপার) সমৃদ্ধিতে কৃষি একটি বড় ভূমিকা পালন করে৷ বেশিরভাগ কৃষি পণ্য মুম্বাইতে রপ্তানি করা হয়। এগুলির মধ্যে মূলত ভুট্টা, আম এবং আখ থাকে। মাধাপারে'র অনেক বাসিন্দা যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় বাস করেন। তারা ভারতে অর্থ সঞ্চয় করতে ভালোবাসেন৷ সেইজন্য মাধাপারকে ২০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের ব্যাংক আমানতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ধনী গ্রামগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে। এটি এনআরআই ব্যারোমিটার হিসেবে খ্যাত।
মাধাপারের জনগোষ্ঠী তাদের গ্রামের প্রতি বিপুল ভালোবাসা রয়েছে৷ তারা কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেছে৷ তাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও ঐতিহ্য বজায় রাখতে লন্ডনে কচ্ছ-মাধাপার কার্যালয় গড়ে তুলেছে। সকালে বেশি মানুষকে পাওয়া গেলো না৷ যে কজনের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা বৃত্তিগত শিক্ষা নিতেই বেশি আগ্রহী৷ গ্রামের ১০০ ভাগ শিশুরাই স্কুলে পড়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন