Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২২

দুর্গাপূজার তাত্ত্বিক দিক ও বিজয়া দশমী (পর্ব–২)

দুর্গাপূজার তাত্ত্বিক দিক ও বিজয়া দশমী (পর্ব–২)

রবীন্দ্রনাথ তরফদার

এবার অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধে যাবার জন্য দেবতারা নানাভাবে দেবীকে সাজাতে লাগলেন। ক্ষীর সমুদ্র দেবীকে মুক্তার তৈরি কন্ঠের অলংকার দিলেন। মাথার মুকুটের জন্য একটি চুড়ামণি, সোনার তৈরি হাতের বালা, ললাটে পরবার জন্য অর্ধচন্দ্রের আকারে নির্মিত অলংকার। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা একটি কুঠার দিলেন, যা অত্যন্ত ধারালো। হিমালয় দিলেন তাঁর পাহাড়ের এক শ্বেত বর্ণের সিংহ যা হলো দেবীর বাহন। এই সিংহ সাধারণ সিংহ নয়। 

স্বয়ং নারায়ণের একবার সাধ হয়েছিল দেবীকে নিজের মাথায় করে রাখবেন। সেই স্বাদ মেটানোর জন্য তিনি সিংহ হয়ে এসেছেন। কুবের দিলেন অদ্ভুত এক সুরাপাত্র, যা কখনও শেষ হবে না। বাসুকী অনন্ত নাগ দেবীকে একটি নাগহার উপহার দিলেন। এইভাবে সমস্ত দেবতাদের দ্বারা সজ্জিত হয়ে আনন্দিতা দেবী অট্টহাসিতে গর্জন করতে লাগলেন। কেঁপে উঠল ত্রিভুবন। দেবতারা বুঝতে পারলেন যে এবার অসুরদের পরাজয় নিশ্চিত।

মহিষাসুর দেবীর হুংকার শুনে এবং পৃথিবীকে কম্পিত হতে দেখে প্রাসাদের বাইরে এসে দেখলেন অপূর্ব দর্শন এক নারী অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পদভারে পৃথিবী অবনমিতা, তাঁর মাথার মুকুট আকাশ স্পর্শ করে আছে। মহিষাসুর এই নারীকে যুদ্ধে পরাজিত করবার জন্য তার সেনাবাহিনীকে আদেশ দিল। 

দুর্দান্ত সব অসুর সেনাপতিদের একে একে পাঠাল যুদ্ধ করতে। সেনাপতি চিক্ষুর ও চামর নামে দুই অসুর তাদের হাতি, ঘোড়া, রথ এবং পদাতিক সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হল। দেবীর বাহন সিংহ যুদ্ধে সমানভাবে সাহায্য করতে লাগলো। দেবী নানা অস্ত্রে অসুরদের বধ করতে লাগলেন। 

লক্ষ কোটি হাতি ঘোড়া, রথ এলো। কোটি কোটি পদাতিক সৈন্য নিহত হলো। রক্তের নদী বইতে লাগলো।  দেবীর ত্রিশুলের আঘাতে চিক্ষুর, বাস্কল, অন্ধক, উগ্রাস্য, মহাহনু, দুর্মুখ, দুর্দ্ধর অচিরেই প্রাণ ত্যাগ করল। অবশেষে মহিষাসুর স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হল। মায়াবী এই অসুর মহিষের রূপ ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবল বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলো।  

মহিষরূপধারী অসুর গর্জন করতে করতে তার সিং দিয়ে পাহাড়-পর্বত তুলে দেবীর দিকে ছুঁড়তে লাগলো। পুরাণে বলা হয়- মহিষাসুর শিবাংশে জাত। মহাপরাক্রমশালী মহিষাসুরের বীরত্বকে দেবী আর সহ্য করলেন না। 

তিনি সিংহের পিঠের উপর উঠে দাঁড়িয়ে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মহিষের গলার কাছে চেপে ধরে তাকে ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। তার পায়ের আঙুলের চাপে মহিষের গলা দিয়ে আধখানা শরীর বেরিয়ে এলেই দেবীর খড়্গের আঘাতে মহিষাসুর নিহত হল। দেবতারা নিশ্চিন্ত হলেন।

দেবি ভগবতী কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে মহালয়ার পূর্ব দিন চতুর্দশীতে দেবতাদের তেজ থেকে সৃষ্টা হন। ষষ্ঠী পর্যন্ত তিনি আশ্রমে সজ্জিতা হন এবং অন্যান্য অসুরদের বধ করেন। সপ্তমী ও অষ্টমীতে তিনি কাত্যায়ন ঋষি ও দেবতাদের দ্বারা পূজিতা হয়ে নবমীতে মহিষাসুরকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন। দশমীতে দেবতারা বিজয় উৎসব করেন।

অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির বিজয় উপলক্ষে যে উদযাপন সেই উৎসবের নামই বিজয়া দশমী। দুর্গোৎসব বাঙালির ধর্ম ও সমাজ চেতনার অন্তঃস্থলকে যেমন স্পর্শ করেছে, তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলার আগমনী সংগীতে, শাক্ত পদাবলীতে, পাঁচালী ও মঙ্গলকাব্যে দেবী দুর্গার যে ঘরোয়া রূপের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তাতে ধর্মীয়জীবন, আধ্যাত্মিক সাধনা, পারিবারিক সম্পর্কের বিন্যাস, ভক্তি এবং বাৎসল্য এমন ভাবে মিলেমিশে গেছে যে তাদের আলাদা অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। 

দেবতা ও মানুষের এই অপরূপ মেলবন্ধন, এই আত্মিক সম্পর্ক একটি মধুর মাত্রা লাভ করেছে যার তুলনা জগতে দুর্লভ। মর্ত্যের মানুষ স্বর্গের দেবতাকে ভয় ও ভক্তির আবেষ্টনি থেকে বের করে আপন গৃহ ও পরিবারের অভ্যন্তরে স্থাপন করেছে ফলে বছরে চার দিনের জন্য আমাদের ঘর ভরে যায় সপরিবারে একাধারে মাতা ও কন্যার পদার্পনে। 

আত্মকেন্দ্রিকতা এবং পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার মানসিকতার মতো অত্যাধুনিক প্রবণতা আমাদের আচ্ছন্ন করার পূর্বে আমরা সুখে দুঃখে আনন্দে বিপদে যে একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস করতাম, বিজয়া দশমী উপলক্ষে সেই পরিবেশটি আমাদের কাছে যেন নতুন করে ফিরে আসে। কিছু সময়ের জন্য একটি স্বর্ণসূত্রে যেন আমরা বাঁধা পড়ি। জীবনের হাসি-কান্না এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বা কোনও বিরোধ এই বিজয় উৎসবের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। 

পারস্পরিক আলিঙ্গন, প্রণাম, কোলাকুলি, নমস্কার এমন এক সর্বজনীন বাতাবরণ সৃষ্টি করে যেখান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে অসাম্য, বৈষম্য ও ধর্মীয় বিভেদ। সিঁদুর খেলা ও মিষ্টি মুখের ব্যাপকতর আয়োজনে ঘরের মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো শেষ পর্যন্ত আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে এই আশ্বাসে যে, আসছে বছর মা আবার আসবে। এই প্রত্যাশাই তো জীবনকে সমৃদ্ধ করে, নবতর চেতনায় উজ্জীবিত করে।‌‌



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন