দুর্গাপূজার তাত্ত্বিক দিক ও বিজয়া দশমী (পর্ব–১)
রবীন্দ্রনাথ তরফদার
ভারতবর্ষের অধ্যাত্ম-ভাবনায় মাতৃবন্দনা সর্বব্যাপীতা লাভ করেছে। অতি প্রাচীন কাল থেকেই সমগ্র জগতশক্তিকে ভারতবর্ষ মা বলে ভেবে এসেছে। ভারতের বৈদিক সাহিত্যেও পৃথিবী দেবী হিসেবে মহিমান্বিতা। ঋগ্বেদের ঋষি বলেছেন "মাতা পৃথিবী মহীয়ম্"---বিস্তীর্ণা পৃথিবী আমার মা। ঋগ্বেদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দৌ বা স্বর্গ বা আকাশের সঙ্গে পৃথিবীর নাম উচ্চারিত।
ঋগ্বেদে 'দৌ' জগতের পিতা রূপে এবং পৃথিবী জগতের মাতা রূপে কল্পিত। আকাশ থেকে পতিত বৃষ্টিধারা পৃথিবীকে ফুল, ফল ও শস্যে পূর্ণ করে তোলে। পৃথিবী মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী, কীট পতঙ্গের আদর্শ বাসভূমি হয়ে ওঠে। ঋগ্বেদে 'আদিত্যগণের' জননী দেবী অদিতি ও দেবী পৃথিবী অভিন্না। ঋগ্বেদের এই পৃথিবী-অদিতির কল্পনাই হিন্দু ভারতের শক্তিপূজার আদি উৎস।
শ্রী শ্রী চন্ডী স্বয়ং একটি স্তবগ্রন্থ। ভগবতী দুর্গার অপার মহিমা এই গ্রন্থের তিনটি অধ্যায়ে সাবলীল ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। এই পবিত্র গ্রন্থের প্রত্যেকটি শ্লোকে রয়েছে সঞ্জীবনী মহামন্ত্র। এই মন্ত্র একটু নিষ্ঠা সহযোগে উচ্চারণ করলে আমাদের অন্তর আত্মশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে মনের তমো সংস্কারের বিনাশ ঘটে। তখন জীবনে চলার পথ সাবলীলতা লাভ করে।
দুর্গাপূজার ভাবগত অর্থ হলো, অন্তরের অশুভ রিপুগুলির বিনাশ করা। আমাদের মন যদি লোভ, মোহ, স্বার্থপরতা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতায় পূর্ণ হয়, তখন দেহে-মনে-চিন্তায়-কর্মে কোনও সংহতি থাকে না। তখন আমাদের সত্তা খন্ডিত হয়। তামসিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ আমাদের গ্রাস করে। আমাদের চিত্রক্ষেত্রই হল সেই স্বর্গরাজ্য যেখানে শুভ গুণগুলি হল দেবতা আর অশুভ দিকগুলি হল অসুর। এই শুভাশুভের দ্বন্দ্বে অশুভকে পরাজিত করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে সত্যলাভের পথে অগ্রসর হওয়া।
প্রাচীনকালে যখন অসুরদের রাজা ছিল মহিষাসুর, তখন দেবতাদের অধিপতি ছিলেন পুরন্দর। এই সময় দেবতা ও অসুরদের মধ্যে ১০০ বছর ধরে দারুণ যুদ্ধ হয়েছিল। অসুরদের রাজা মহিষাসুর ছিল মহাশক্তিধর, আবার তপস্বী সাধকও বটে। ব্রহ্মার আশীর্বাদে মহিষাসুর ছিল মহাপরাক্রমশালী।
দেবতাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মহিষাসুর স্বর্গরাজ্য দখল করে এবং সমস্ত ক্ষমতা অধিকার ক'রে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে নিজেকে স্বর্গাধিপতি বলে প্রচার করে। এর ফলে পরাজিত দেবতারা স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে ব্রহ্মা-বিষ্ণু ও শিবের নিকট হাজির হন। তারা নিজেদের দুর্দশার কথা ব্যক্ত করলে শিব ও বিষ্ণু ভীষণ ক্রুদ্ধ হন।
তখন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের শরীরের ক্রোধজাত তেজ ধীরে ধীরে তাদের মুখ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে। দেবতাদের তেজোরাশির বহিঃপ্রকাশ দেখে অন্যান্য দেবতারাও তাদের তেজ প্রকাশ করতে লাগলেন।
সমস্ত দেবতাদের তেজ একত্রিত হয়ে এক অপরূপা জ্যোতির্ময়ী দেবী মূর্তির সৃষ্টি হল। এই দেবীর বিশাল তেজোদ্দীপ্ত দেহটি সৃষ্টি হল হিমালয়ের এক নিভৃত তপোবন কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে। কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে আবির্ভূত বলে দেবীর নাম হলো কাত্যায়নী।
শিবের তেজে দেবীর মুখমণ্ডল তৈরি হলো বলে তার মুখ হল শ্বেতবর্ণ। বিষ্ণুর তেজে তার হাতগুলি হল নীল রঙের। যমের তেজে তার কেশপাশ হলো কৃষ্ণবর্ণ। ইন্দ্রের তেজে তাঁর দেহের মধ্যস্থল হল রক্তবর্ণ, ব্রহ্মার তেজে তার চরণ দুটি রক্তবর্ণ, আর সূর্যের তেজে চরণের আঙুলগুলিও হল রক্তবর্ণ। কুবেরের তেজে নাসিকা হল শ্বেতবর্ণের।
দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিদের তেজে দেবীর দাঁতগুলি হল শ্বেত বর্ণের। অগ্নির তেজে তার দীপ্ত উজ্জ্বল ত্রিনয়ন সৃষ্টি হল। পবন দেবের তেজে দেবীর কর্ণযুগল এবং অন্যান্য দেবগণের দেহজাত তেজ একত্রিত হয়ে এক মঙ্গলময়ী দেবী মূর্তি সৃষ্টি হল। এই দেবীই হলেন স্বয়ং আদ্যা শক্তি মহামায়া।
এই সর্বরুপময়ী দেবীকে যুদ্ধের জন্য দেবতারা নানা অস্ত্রে সাজিয়ে দিতে লাগলেন। মহাদেব নিজের ত্রিশূল থেকে একটি পিনাক বা ত্রিশূল দেবীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। বিষ্ণু দিলেন সুদর্শন চক্র। বরুণ দিলেন শঙ্খ। অগ্নি দিলেন শক্তিবলে এক বিশেষ ধরনের অস্ত্র যেটি প্রায় দুই হাত লম্বা সিংহের মত মুখবিশিষ্ট। এটি লোহার তৈরি, বর্শার মতো ছুঁড়ে মারতে হয় (যজুর্বেদে এইসব অস্ত্রের বর্ণনা দেওয়া আছে)।
বায়ু দিলেন বাণপূর্ণ দুটি অক্ষয় তুণীর, যাতে বাণ রাখা হয় আর একটি ধনু। দেবরাজ ইন্দ্র দিলেন একটি বজ্র ও ঐরাবত হাতির গলা থেকে একটি ঘন্টা। যম দিলেন তার কালদণ্ড থেকে একটি দন্ড আর বরুণ দিলেন নাগপাশ। প্রজাপতি ব্রহ্মা দিলেন রুদ্রাক্ষের মালা এবং মন্ত্রপূত জলে পরিপূর্ণ একটি কমন্ডলু। এই জল শত্রুকে নির্জীব করে দেয়। সূর্য তার প্রচন্ড কিরণ দেবীর সর্বাঙ্গে ঢেলে দিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন