উনিশ শতকে কলকাতার দুর্গাপুজো : পর্ব– ২
স্বপন ঘোষ
পুরোনো কলকাতার সমাজচিত্র বিষয়ক পত্র-পত্রিকা থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে বাবু খেলাৎ চন্দ্র ঘোষের বাড়িতে অতি সাড়ম্বরে দুর্গাপুজো হতো। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বাড়ি গিশগিশ করত। বাবু দেড় ফুট উচু গদির ওপর তসরের কাপড় পরে তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসতেন।
দেওয়ান টাকা ও সিকি-আধুলির তোড়া নিয়ে খাতা খুলে হিসাব করতেন। জুহুরী জড়োয়া গহনার পুটুলি আর ঢাকাই মহাজন ঢাকাই শাড়ির পশরা নিয়ে বাবু ও দেওয়ানকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত থাকত। বাইরের দালাল, যাত্রার অধিকারী ও গাইয়ে ভিক্ষুকরা 'যে আজ্ঞে', 'যো হুজুর' বলে বাবুকে তুষ্ট করার চেষ্টা করত।
সমকালীন সাহিত্য বলছে, চতুর্থী পার করে পঞ্চমীর সকাল থেকেই ময়রারা দুর্গোমোণ্ডা ও আগা তোলা সন্দেশের ওজন দিতে আরম্ভ করত। পাঁঠার রেজিমেন্ট বাজারে প্যারেড করত। গন্ধবেনেরা মশলার ব্যবসা করে দুপয়সা ঘরে তোলার আশায় ব্যস্ত হয় পড়ত।
ষষ্ঠীতে বাজারের শেষ কেনা বেচা, মহাজনের শেষ তাগাদা, আশার শেষ ভরসা। শহরের বড় রাস্তায় চলাচল মুশকিল হতো। দোকানে খদ্দের বসবার স্থান থাকত না। বাবুদের বাড়ির চাপরাশি, আরদালি, ঢুলিরা সব নতুন পোশাকে সজ্জিত। বাজত রোশনচৌকি আর সানাইয়ের সুর।
বাইরে অবশ্য ভিক্ষুকের মেলা লেগে যেত। মেথরপট্টি ও নামকরা বস্তিগুলিতে অবশ্য মানুষের পুজো নিয়ে আলাদা কোনও অনুভূতি ছিল না। শহরের মোড় ও চৌরাস্তা ঢুলি ও বাজনদারদের ভিড়ে পা ফেলার অযোগ্য হয়ে পড়ত। উনিশ শতকীয় সাহিত্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে : "ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় শহরে প্রিতিমার অধিবাস হয়ে গ্যাল, কিছুক্ষণ ঢোল ঢাকের শব্দ থামলো, পুজোর বাড়িতে ক্রমে 'আনরে', 'কররে,' 'এটা কি হলো' কত্তে কত্তে ষষ্ঠীর শর্বরী অবসন্ন হলো।"
বাজনা-বাদ্দি সহযোগে কলাবৌ স্নান করানোর সংস্কৃতি খুব জমজমাট ছিল। ডিরোজিওর অনুগামী ইয়ংবেঙ্গলের সদস্যগণ একসময় শহর কলকাতায় পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তীব্র আলোড়ন তুলেছিলেন।
কিন্তু ইয়ংবেঙ্গলের অনেক সদস্যই পরে ভোল বদলেছিলেন। অনেকেই পৌত্তলিকতার দাস হিসাবে পুজো-অর্চনায় মন দিয়েছিলেন। বিদ্রুপ করে তাঁদের পুজো সম্পর্কে লেখা পাওয়া যায়:
"বিলেত থ্যাকে অর্ডার দিয়ে সাজ আনিয়ে প্রতিমে সাজান হয়-মা দুর্গা মুকুটের পরিবর্ত্তে বনেট পরেন, শ্যাণ্ডউইচের শেতল খান আর কলাবউ গঙ্গাজলের পরিবর্ত্তে কাৎলীকরা গরম জলে স্নান করে থাকেন, শেষে সেই প্রসাদী গরম জলে কর্ম্মকর্ত্তার প্রাতরাশের টী ও কফি প্রস্তুত হয়।"
উনিশ শতকে কলকাতার বারোয়ারি এবং বাবুদের বাড়ির পুজোতে দানের আতিশয্য, গানের গুলতানি এবং ভুরি ভোজের অকারণ আয়োজন ছিল নজরকাড়া। আয়োজনের আতিশয্যের মধ্যেই ষষ্ঠী, সপ্তমী ও অষ্টমী কেটে যেত। নবমীর দিন বলির ধূম পড়ে যেত।
কোথাও জোড়া মোষ, কোথাও নব্বইটা পাঁঠা, কোথাও আখ, সুপারি, কুমড়ো, মাগুরমাছ ও মরীচ বলিদানের প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায়। অথচ কাঙালী, রেওভাট ও ভিক্ষুকের পূজোবাড়ি ঢোকা দূরে থাকুক, মশা গলার উপায় পর্যন্ত থাকতনা।
দশমীর দিন দইকড়মা ভোগ দিয়ে প্রতিমার নিরঞ্জন করা হতো আরতীর পর বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠত। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে উনিশ শতকে নেহাত কম আন্দোলন হয়নি। অথচ সাধারণ বাঙালি পরিবার থেকে কৃতবিদ্য বাঙালি পর্যন্ত সকলেই সংসার ও জগদীশ্বরের সমস্ত তত্ত্ব অবগত থাকতেন।
পাশাপাশি, সংসার অথবা সমাজের অনুরোধে পুতুল পুজোতে আমোদ প্রকাশ করেন, বিসর্জনের সময় কাঁদেন এবং কাদা মেখে কোলাকুলি করেন। নাস্তিকতায় নাম লিখিয়ে বনে বসে থাকা ভাল, তবু "জগদীশ্বর একমাত্র" জেনেও পুতুল পুজোয় আমোদ প্রকাশ করা উচিত নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন