মহালয়ার তর্পণে জেগে ওঠে ইছামতী, নাওভাঙা, যমুনা
পীযূষ হালদার
মহালয়া ঘিরে রয়েছে অনেক গল্প। বনগাঁ মহকুমার বিভিন্ন প্রান্তে পিতৃতর্পণের রেওয়াজও আছে। মহালয়া হল পিতৃপক্ষের শেষে তিলাঞ্জলি তর্পণ করে মাতৃপক্ষের সূচনা। শাস্ত্রমতে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে জল দান করে স্মরণ করা হয় এই দিনে।
আমরা সাধারণত মহালয়া বলে অভিহিত করি, সেটা হিন্দু ধর্মের মতে। তর্পণ করার জন্য এক বিশেষ পর্ব বা পূর্বপুরুষের তর্পণআদির জন্য প্রশস্ত পক্ষ। এই পক্ষ আরও বিভিন্ন নামে পরিচিত, ষোলাশ্রাদ্ধ, মহালয়া পক্ষ, পিতৃপক্ষ, জিতিয়া, কালাগাত এবং অপর পক্ষ।
যার পিতা জীবিত আছেন, তিনি তর্পণ করতে পারবেন না। কারণ তর্পণ করা বলতে বোঝায়, মৃত পূর্বপুরুষদের জল দান করা। তর্পণ করার জন্য গঙ্গায় যেতেই হবে, এমনটা নয়। যে কোনও পরিষ্কার জলাশয়ে শুদ্ধভাবে তর্পণ করা যায়।
তর্পণ কথাটি এসেছে 'তৃপ' কথা থেকে। তৃপ কথার অর্থ হল সন্তুষ্ট করা। পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির জন্য জল নিবেদন করা হয়, একেই তর্পণ বলে। তর্পণ করতে গঙ্গাজল, চন্দন, কালো তিল, কুশ, তুলসীপাতা, হরিতকী, চাল, দূর্বা দরকার হয়। নদীতে স্নান করে নাভি পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে এই তর্পণ করতে হয়।
নির্দিষ্ট সময়ে তর্পণের পর মাতৃ পক্ষের সূচনা হয়। শুরু হয় মাতৃ বন্দনা, আগমনী। শক্তির উৎস মাতৃশক্তি, নারীই দেবী। তাই পিতৃপুরুষকে প্রীত করে মহাশক্তিকে স্মরণ করা। আসল বার্তাটি হল গোটা বিশ্বজগতের প্রতিটি পরমাণুর সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক বোঝানো।
সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের নাম মহালয়া। মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনা। পুরাণ অনুযায়ী, আশ্বিনের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে মহর্ষী কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভাব হন এক অপূর্ব সুন্দরী নারী। তিনিই দেবী দুর্গা। তাই ওইদিন দেবীপক্ষের সূচনায় মঙ্গলময়ীর আবাহণ মন্ত্রে দিগন্ত মুখরিত হয়।
সমস্ত বাংলা এবং বাঙালির সঙ্গে বনগাঁ মহকুমায় এই মঙ্গল কাজ ইচ্ছামতী, যমুনা, কোদালিয়া নদীতে যুগ যুগ ধরে সম্পন্ন হয়ে আসছে। তাছাড়া, বনগাঁর খুব কাছাকাছি চাকদার গঙ্গা নদী হওয়ায় সেখানেও তর্পনের রেওয়াজ আছে বনগাঁবাসীর।
বনগাঁর ইছামতির ঘাটে ঘাটে অনেক আগে থেকেই তর্পনের রেওয়াজ আছে। দত্তপাড়ার জমিদারদের কাছারিবাড়ি ছিল। বনগাঁর দ্বিতীয় জমিদার সুরনাথের ডায়েরি থেকে জানা যায়, মহালয়ার ভোরে কলঘাটে পিতৃতর্পণ করতেন। তারপর কাছারিবাড়িতে চণ্ডীপাঠ ও আগমনী গানের মধ্যে দিয়ে দেবীকে আবাহন করা হতো। এছাড়াও সাতভাই কালিতলা, বোটেরপুল, মতিগঞ্জ হাটখোলার ঘাটে তর্পণ করা হতো। এখন বনগাঁ থানার মধ্যে যে ঘাট, সেখানেই তর্পণ করা হয়।
প্রায় চারশো বছরের পুরনো বৈরামপুরের রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। সুরেশ্বর রায়ের পৌত্র সন্তোষ রায়ের সময় থেকে দুর্গাপূজো চালু হয়। তিনি তাঁর প্রাসাদের পাশে বড় দিঘি খনন করে নেন। মন্দিরময় দিঘির চারপাশেই ছিল অনেকগুলি ঘাট। সেখানে যেমন রায়বাড়ির সদস্যরা পিতৃতর্পণ করতেন, তেমনই সাধারণ মানুষও তাদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতেন।
ছয়ঘরিয়ার জমিদার বাড়ির পুজো বনগাঁর প্রাচীন পুজোর অন্যতম। তখন খরস্রোতা ছিল নাওভাঙা নদী। জমিদার বাড়ির মানুষেরা এবং তাঁদের আত্মীয় পরিজন নাওভাঙা নদীতেই তর্পণ সম্পন্ন করতেন। মহকুমার যমুনা নদীতে গাইঘাটা, গোবরডাঙা, ইছাপুরের মানুষ পিতৃতর্পণ করতেন।
মহালয়া আর মহিষাসুরমর্দিনী প্রায় সমার্থক শব্দ। আকাশবাণী থেকে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় বাংলা প্রভাতী বেতার অনুষ্ঠান। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটি প্রতিবছর মহালয়ার দিন সম্প্রচারিত হয়। যা ভারতের বেতারের ইতিহাসে দীর্ঘতমকাল ধরে সম্প্রচারিত একটা অনুষ্ঠান। চণ্ডীপাঠ, বাংলা ভক্তিগীতি, ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং পৌরাণিক কাহিনীর নাট্যরূপ এই মহিষাসুরমর্দিনী।
প্রথমদিকে মহিষাসুরমর্দিনী সরাসরি সম্প্রচার করা হতো আকাশবাণী থেকে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে রেকর্ডিং সম্পন্ন হলে তারপর থেকে প্রতিবছর রেকর্ড বাজিয়েই পুনঃসম্প্রচার করা হয়। বহু সঙ্গীতশিল্পী এবং ভাষ্যকারের সমন্বয়ে এই অনুষ্ঠান। রচয়িতা ও প্রবর্তক বাণীকুমার, সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ কুমার মল্লিক, গ্রন্থনা ও শ্লোক পাঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এই গুণীজনদের নাম না করলে প্রতিবেদন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আগে ঘরে ঘরে রেডিও বা ট্রানজিস্টর ছিল না। পাড়ার মধ্যে যে বাড়িতে রেডিও থাকত, সেখানে প্রতিবেশীরা এসে মহিষাসুরমর্দিনীর অনুষ্ঠান শুনতেন। কখনও কখনও বারোয়ারি পুজো মন্ডপে মাইক বাজিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। এখনও গ্রাম কিম্বা শহরের কিছু কিছু বাড়িতে মহালয়ার দিন ভোর রাতে ট্রানজিস্টরে মহিষাসুরমর্দিনী বেজে ওঠে।
এছাড়াও এখন অ্যান্ড্রয়েড ফোনে যখন খুশি মহিষাসুরমর্দিনী শোনা যায়। কিন্তু পুজোর আমেজ পাওয়া যায় ভোর রাতে সারাবাংলার পথে-প্রান্তর এবং লোকালয় মহিষাসুরমর্দিনীর ঐশিক মন্ত্র উচ্চারণের স্বরে যখন গমগম করে ওঠে, সেই সময়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন