আকস্মিকভাবে স্বতন্ত্র আবিষ্কার ঘটেছে যে বিদ্যুতের
অজয় মজুমদার
অনেকদিন আগে ইতালি দেশের বোলোগণা বিশ্ববিদ্যালয়ে লুইজি গ্যালভ্যানি (১৭৩৭–১৭৯৮ খ্রিঃ) নামে শারীরবিদ্যার এক অধ্যাপক ছিলেন৷ একদিন একজোড়া ব্যাঙের ঠ্যাং এনে তার গঠন বৈচিত্র্য ছাত্রদের বোঝানোর জন্য গ্যালভ্যানি তা টেবিলের উপর রাখলেন৷ তারপর ঠ্যাং দুটো একটি ধাতু নির্মিত ট্রের উপর তুলে নিয়ে একটি ধাতব শলাকার সাহায্যে স্পর্শ করে তার শিরা, উপশিরা, স্নায়ু ইত্যাদির অবস্থান তিনি ছাত্রদের বোঝাতে গেলেন।
ধাতু-শলাকা দিয়ে যেই না তিনি ব্যাঙের ঠ্যাং স্পর্শ করলেন, অমনি সেটি একটু লাফিয়ে উঠলো। তাই দেখে অবাক হলেন অধ্যাপক মশাই৷ অবাক হলো ছাত্ররাও৷ কেন এমন হলো, সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে রইলেন গ্যালভানি i
সেদিনের মতো ক্লাস ছেড়ে দিয়ে অধ্যাপক গ্যালভ্যানি বারবার ওই পরীক্ষাটি করে দেখতে লাগলেন৷ তার পরীক্ষায় কোন ভুল হয়েছে কিনা, না তিনি ঠিকই দেখেছেন। অমন করলে ব্যাঙের ঠ্যাং সত্যি লাফিয়ে ওঠে i
সেদিন বাড়ির বারান্দায় লোহার রেলিং এর উপর গ্যালভ্যানি একটি ব্যাঙের ঠ্যাং শুকাতে দিয়েছিলেন। তামার হুকের সাহায্যে রেলিংয়ের উপর ঠ্যাংটি ঝোলানো ছিল৷ যখনই হালকা লেগে ঠ্যাংটি লোহার রেলিং স্পর্শ করছিল, তখনই তা লাকিয়ে উঠছিল।
কী আশ্চর্য, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখানেও i এসম্পর্কে অনেক ভাবনা-চিন্তার পর অধ্যাপক গ্যালভ্যানি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, ব্যাঙের ঠ্যাং নেচে ওঠার মূলে আছে বিদ্যুৎ৷ তিনি ওই বিদ্যুতের নাম দিলেন 'প্রাণিজ বিদ্যুৎ' অর্থাৎ কিনা প্রাণীর দেহজাত বিদ্যুৎ৷
গ্যালভ্যানির এই সিদ্ধান্ত অন্যান্য বিজ্ঞানীরা মেনে নিতে রাজি হলেন না। তারা এই নিয়ে আরও পরীক্ষা চালাতে লাগলেন৷ শেষে ইতালি দেশের নাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলেজান্দ্রে ভোল্টা(১৭৪৫–১৮২৭ খ্রি:) এই সমস্যার এক সুষ্ঠু সমাধান খুঁজে পেলেন৷
তিনি প্রমাণ করলেন যে, ব্যাঙের ঠ্যাং নেচে বা লাফিয়ে ওঠার মূলে আছে বিদ্যুৎ– এ কথা ঠিকই৷ তবে এই বিদ্যুৎ ব্যাঙের দেহে আপনা আপনি সৃষ্টি করে না; সৃষ্টি হয় রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে।
দুটি বিভিন্ন ধাতু খাদ্য লবনের দ্রবণের সংস্পর্শে রাখলে যে রাসায়নিক ক্রিয়া ঘটে, তারই ফলে উৎপন্ন হয় এই বিদ্যুৎ৷ ব্যাঙের কোষে খাদ্যলবনের দ্রবণ সঞ্চিত থাকে৷ দুটি বিভিন্ন ধাতু দ্বারা যখনই ব্যাঙের ঠ্যাং স্পর্শ করা হয়, তখনই ধাতু দুটি লবণের দ্রবণের সংস্পর্শে এসে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে৷ আর সেই বিদ্যুতের ক্রিয়াতেই ঠ্যাং লাফিয়ে ওঠে৷
এই যুক্তি যে সত্যি 'ভোল্টী স্তুপ' তৈরি করে, অধ্যাপক ভোল্টা তা প্রমাণ করলেন৷ একটি তামার চাকতি ও একটি দস্তার চাকতির মধ্যে খাদ্য লবনের দ্রবণে ভেজানো ব্লটিং কাগজ রেখে এবং এই রকমভাবে অনেকগুলি তামা ও দস্তার চাকতি পরপর স্তূপাকারে সাজিয়ে রেখে অধ্যাপক ভোল্টা তৈরি করলেন 'ভোল্টীয় স্তূপ' i
তারপর সেই স্তুপের সবচেয়ে উপরের ও নিচের ধাতব চাকতি দুটি তামার তার দিয়ে যুক্ত করে তিনি সেই তারের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহের অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন। এমনিভাবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম তড়িৎ কোষ তৈরি হলো৷ কিন্তু এই আবিষ্কারের মূলে ছিল এক আকস্মিক ঘটনা– অধ্যাপক গ্যালভ্যানির প্রত্যক্ষ করা সেই ব্যাঙের ঠ্যাং লাফানোর ঘটনা৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন