ব্ল্যাক ডায়মন্ড — পর্ব-২
অজয় মজুমদার
ভারতে কয়লার চাহিদা সৃষ্টি ও তার জন্য বিশেষভাবে কয়লার সন্ধান খুব বেশি দিনের কথা নয়৷ রাজনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে দেখা যায়, ইংল্যান্ডের শিল্প-বিপ্লবের প্রভাব ভারতেও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল৷ প্রধানত ব্রিটিশ আধিপত্যের জন্যই। আর এই জন্য কয়লার ব্যাপারে ভারত খুব বেশি পিছিয়ে থাকেনি৷
অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ দেশে কামান, বন্দুক ইত্যাদি অস্ত্র-শস্ত্র তৈরী করার ব্যাপারেও দেশে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল৷ অস্ত্র তৈরির কারখানার জন্য সেই সময় কয়লা আসতো ইউরোপ থেকে৷ তখন সব সময় সেই কয়লার উপর ভরসা করে থাকতে হতো।
অন্য দেশের উপর নির্ভর করে থাকাটা ব্রিটিশদের অনেকেরই ভালো লাগছিল না৷ তাঁরা এদেশেই কাজ চালানোর মতো কয়লা পাওয়া যায় কিনা ভাবছিলেন৷ কাজের সূত্র থেকেই এদেশে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির মধ্যে দিয়েই কোথাও কোথাও ছোটখাটো কয়লার খাদ, কোথাওবা নদীর ধারে দুএকটা কয়লার স্তর-এসব ব্রিটিশদের চোখে পড়েছিল।
কিন্তু সেই কয়লা কি কাজে আসবে ? এই প্রশ্নটাই অনেকের মনে ঘুরছিল। পুরনো নথিপত্র ঘাটলে দেখা যায় যে, খনি থেকে কয়লা তোলার কাজে সাহস করে এগিয়ে এসেছিলেন ১৭৭৪ সালে জন সুমনের আর স্যুটেনাস গ্রান্ট হিটলে নামে দু'জন সরকারি কর্মচারী৷ তাঁরা সরকারের কাছে এই কাজের জন্য জায়গার নাম দিয়ে আবেদন করলেন। সেটি ওয়ারেন হেস্টিংস এর কর্তৃত্বের সময়।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এব্যাপারে সরকারের অনুমোদনও তারা পেয়ে গিয়েছিলেন। রাণীগঞ্জ অঞ্চলে চিনাকুরী, এথেরা, দামুলিয়া– এই তিনটি জায়গায় তারা কয়েক হাজার মন কয়লা তোলালেন৷ ভারতের সরকারি কাগজপত্রে এটাই প্রথম কয়লা খনির কাজের বিবরণ৷
ওই কয়লা থেকে সুমনের ও হিটলে সাহেব প্রায় আড়াই হাজার মনের মতো কয়লা পাঠিয়ে দিলেন সরকারি অস্ত্রাগারের কয়লা, যেখানে পরীক্ষা করা হয় সেখানে। পরীক্ষার ফলটা কিন্তু উৎসাহ আনতে পারল না। কারণ দেখা গেল, ওই কয়লার গুণগত মান ভালো নয়৷
ফলে বেশ কিছুদিনের জন্য দেশে কয়লা তোলার উৎসাহে ভাটা পড়লো৷ তারপর লর্ড ময়রা ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে যখন ভারতে বড়লাট হয়ে এলেন, তিনি তখন কয়লা তোলার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন৷ কয়লার ব্যাপারে অন্য দেশের উপর নির্ভর করা তাঁর একেবারে পছন্দ হলো না৷ এর ফলে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই ভারতে সরকারি প্রচেষ্টায় খনি থেকে কয়লা তোলার কাজ কিছুটা এগোয়৷
উইলিয়াম জনস(william Jones) নামে একজন কয়লাখনির বিশেষজ্ঞ হিসাবে এই সময় আনুমানিক বছর পাঁচেক পরিশ্রম করে কিছু কয়লা খনির জায়গার সন্ধান বার করেছিলেন। জায়গাগুলি আজকের পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার সীমান্ত এলাকায়৷ শুধু তাই নয়, কোথায়–কিভাবে খনির কাজে এগিয়ে যাওয়া যায়, সে ব্যাপারেও তাঁর অবদান তুলনাহীন৷
এভাবে ছোটখাট খনি বা খাদের সন্ধান বিহারে এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গাতেই পাওয়া যাচ্ছিল। তবে সে আমলে দেশে যোগাযোগের ও পরিবহনের সুবিধা ছিল না বলেই খনির কাজে কেউ উৎসাহ পেতো না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই বিহারের গিরিডি, রাজমহল আর ডালটনগঞ্জের কাছে রাজহারা অঞ্চলের কয়লার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল৷
এই সময় গঙ্গার জলপথই ছিল পূর্ব ভারতের একমাত্র নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের রাস্তা। কয়লা আসা যাওয়া করত স্টিমারে অথবা নৌকায়। কয়লা খনি এলাকার দামোদর এবং তার উপনদীগুলির সুবিধা ছিল। কিন্তু সেই নদীগুলিতে বর্ষার সময় কয়েক মাস ছাড়া জলই থাকে না। তাই শুধু ওই সময়ের কয়লা খনি এলাকায় নৌকা পৌঁছানো যেত। তাও কয়লা আসতে সময় লাগতো মাসের পর মাস৷
এইসব অসুবিধের মধ্যেও কিন্তু কয়লার সন্ধান চলতে লাগলো। কারণ, ক্রমশই কয়লার চাহিদা বাড়তে লাগলো দেশে। বিদেশ থেকে বিজ্ঞানী ও কলাকুশলী আনিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভালো করে কয়লার সন্ধান শুরু করল। তারই ফলে ভারতে সরকারিভাবে ভূতত্ত্ব সমীক্ষার কাজের গোড়াপত্তন হ'লো ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে দেশে রেলপথ চালু হওয়ার ফলে পরিবহনের কাজ কিছুটা সহজ হলো। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্বালানি হিসাবেও কয়লা বেশ কিছুটা সমাদর লাভ করলো। ক্রমে দেশের এদিক-ওদিক থেকে কয়লা পাওয়ার খবর আসছিল। আর তারপর ভূতাত্ত্বিক সন্ধান চালিয়ে ওইসব জায়গায় নতুন কয়লাক্ষেত্রের (Cold-field) বিশদ বিবরণ ও তথ্য সংগ্রহ চলছিল।
এভাবেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেই অন্ধ্রতে, সিঙ্গারেনির কয়লাক্ষেত্র, মধ্যপ্রদেশের বেশ কয়েকটি কয়লাক্ষেত্র আর উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলেও কয়লাক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেল৷ রেলগাড়ির চলাচলের জন্য কয়লার চাহিদা যেমন বাড়ল, দেশের নতুন নতুন কয়লাক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়ার ফলে সবসময় যান্ত্রিক শিল্প কাজের জ্বালানির ব্যবহারে বড়রকমের আশ্বাসও পাওয়া গেল।
কাছাকাছি কয়লা পাওয়ার সুবিধার জন্যই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকেই আসানসোলের কাছে কুলটিতে লোহা তৈরীর কারখানা গড়ে উঠেছিল। কাছাকাছি কয়লাক্ষেত্রগুলির ওপর ভরসা করেই বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে টাটাদের উৎসাহে জামশেদপুরে আরও বড় লোহার কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলো৷ (শেষ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন