বাইশে শ্রাবণ
রবীন্দ্রনাথ তরফদার
আমাদের জীবনভাবনার মহান স্থপতি রবীন্দ্রনাথ। কালিদাস, শেক্সপীয়ার ও গ্যেঁটের পর বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রপ্রতিভার সঙ্গে তুলনীয় আর কারও নাম করা যায় না। ড. নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেনঃ 'কবে বুঝিব যে নোবেল পুরস্কার রবীন্দ্রনাথকে গৌরবান্বিত করে নাই, রবীন্দ্রনাথই নোবেল পুরস্কারকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন'। অনন্যসাধারণ বৈচিত্র্যে পূর্ণ তাঁর কাব্যের ঐশ্বর্য লক্ষ্য করে ড. উজ্জ্বল কুমার মজুমদার 'রবীন্দ্রনাথ তুমিই আকাশ, তুমিই নীড়' শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের উপর একটি অসাধারণ সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করেছেন।
জীবন রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি অনন্ত প্রাণপ্রবাহের অখন্ড রূপ। তাই মৃত্যু তাঁর কাছে আলাদা কোনও বিষয় নয়, তা জীবনেরই একটি ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যেও অবিনশ্বর প্রাণপ্রবাহের ধারাকে স্বীকার করা হয়েছে। মহাকাল অনন্ত, জীবনধারাও অনন্ত।
তাই ছোট ছোট জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অসীমকেই প্রকাশ করার ব্যাকুলতা রবীন্দ্রজীবনে ও কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। ব্যক্তিজীবনে একাধিক প্রিয়জনের মৃত্যু কবিকে সাময়িকভাবে শোকস্তব্ধ করেছে, কিন্তু মৃত্যুর অভিঘাত তাঁর মনে নবতর জীবনবোধের উন্মেষ ঘটিয়েছে। মরণসাগর পাড়ি দিয়ে জীবনের চিরন্তন যাত্রার পথে তিনি চিরকালের পথিক হয়েছেন।
১০ মার্চ, ১৮৭৫ সালে জননী সারদাদেবীর মৃত্যুকে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি কেমনভাবে গ্রহণ করেছিলেন তা "জীবনস্মৃতি" থেকে উল্লেখ করা যাক।' ....মৃত্যু যে ভয়ঙ্কর, সে দেহে তাহার কোনও লক্ষণ ছিল না----- সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে রূপ দেখিলাম, তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না'। তিনি সুদীর্ঘ জীবনে বারংবার মৃত্যুর দিগন্ত সীমায় জীবনের নবতর বিজয়যাত্রা উপলব্ধি করেছেন।
প্রান্তিক- এর ১৪ সংখ্যক কবিতায় পৃথিবীর অকৃপণ দানকে স্বীকার করে তিনি লিখেছেনঃ- ....'এপারের ক্লান্ত যাত্রা গেলে থামি/ ক্ষণতরে পশ্চাতে ফিরিয়া মোর নম্র নমস্কারে/ বন্দনা করিয়া যাব এ জন্মের অধিদেবতারে'। এ হল জীবনান্তরে যাবার প্রস্তুতি। কবির ধারণায় মৃত্যুস্নানে জীবন নবীন হয়ে ওঠে। যে মহাপ্রাণ জীবনের মধ্যে প্রকাশিত, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার প্রবাহ রক্ষা হয়। তাই তিনি বলেনঃ 'মৃত্যুর সিংহদ্বার দিয়েই জন্মের জয়যাত্রা' (নটীর পূজা)।
এ যেন একটি প্রদীপ থেকে আর একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে নেওয়া। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সীমার বাধা পেরিয়ে জীবন অসীমের সঙ্গে যুক্ত হয়। শেষ সপ্তক-- এর ৩৯ সংখ্যক কবিতায় তিনি লিখেছেনঃ 'আমি মৃত্যু রাখাল। সৃষ্টিকে চরিয়ে চরিয়ে নিয়ে চলেছি নব নব চারণক্ষেত্রে'।
২৭ জুলাই, ১৯৪১। শারীরিকভাবে কবি ভীষণরকম অসুস্থ। এই অবস্থাতেও তিনি রাণী চন্দকে মুখে মুখে বলা কবিতা লিখে নিতে বললেনঃ 'বৎসর বৎসর চলে গেল,/ দিবসের শেষ সূর্য/শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে/ নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়--/কে তুমি।/ পেল না উত্তর'।
৩০ জুলাই, বুধবার, ১৯৪১। কবির অস্ত্রোপচারের দিন। কিন্তু সে কথা তাঁকে তখনও জানানো হয়নি। সকাল ৯টা নাগাদ রাণী চন্দকে তিনি ইসারায় ডেকে একটি কবিতা লিখে নিতে বললেনঃ- 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে,/ হে ছলনাময়ী'। ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। যে পথ কেবলই চলার, যে জীবন আর কাব্য অবিচ্ছিন্ন, সেই মানুষের ক্লান্তি! আবারও একটু পরে মুখে মুখে কবিতা লিখে নেওয়াঃ- 'অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/সে পায় তোমার হাতে/ শান্তির অক্ষয় অধিকার'।
কবিতাটি যখন তাঁকে পড়ে শোনানো হল তিনি বললেন 'একটু ঠিক করতে হবে'। এই ঠিক করার সময় জীবনে আর তিনি পাননি। তাঁর অনুমতিক্রমে অস্ত্রোপচার হয় ১১.২০ মিঃ থেকে ১১.৪৫ মিঃ পর্যন্ত। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর কবি ক্রমশই দুর্বল বোধ করতে থাকেন।
৭ আগষ্ট, বৃহস্পতিবার, ১৯৪১। বাংলা ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮। সকাল থেকেই সংকট তীব্রতর হচ্ছে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সকাল সাতটায় এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপাসনা করলেন, মন্ত্রপাঠ করলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী। বাইরের বারান্দায় উচ্চারিত হচ্ছেঃ শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্।
ঘড়ির কাঁটায় ১২.১০ মিনিট। মর্ত্যজীবন ছেড়ে অমৃতপুরুষ অমৃতধামের পথে পাড়ি দিলেন। বাইশে শ্রাবণ কেবল উদ্ যাপনের নয়, বাইশে শ্রাবণ দিকচিহ্নহীন অনন্ত সময়ের, দেশ কাল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির চৈতন্যলোক উদ্ভাসের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন