গাজন– বাংলার এক নিজস্ব কৃষ্টি (শেষ পর্ব)
পীযূষ হালদার
কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্ক শৈব ধর্মাবলম্বী বলেই পরিচিত ছিলেন। সেই সময় তান্ত্রিক সাধক ও সেন রাজাদের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তীব্র বিরাগ শুরু হয় হিন্দুদের। বৌদ্ধদের শৈব ধর্ম গ্রহণ করার এটি একটি অন্যতম কারণ। রাজা শশাঙ্কের সময়ে অসংখ্য শিব মন্দির তৈরি হয় বাংলায়। সেই সব স্থানেই তখন থেকেই শুরু হয় গাজন উৎসব।
উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা থানা এলাকার জলেশ্বরের শিবরাত্রি ও চৈত্রসংক্রান্তির গাজন উৎসবের কথা ইতিহাস প্রসিদ্ধ। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে গাজন উৎসব পালন করা হয়। জলেশ্বরের প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ থেকে জানা যায় নি, সেটা বিষ্ণু মন্দির না শিব মন্দির। কিন্তু নদীয়ার রাজা ভবানন্দ রায়ের প্রপৌত্র রাঘব রায় ১৬৬৯ খিষ্টাব্দে জলেশ্বরের ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির পুনঃনির্মাণ করে সেখানে শিব মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে ইছামতীর তীরে শিব নিবাসের মন্দির নির্মাণ করে আবার শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ভীম একাদশীতে পুজো ও মেলার সূচনা করেন।
জলেশ্বরের ঢিবির পশ্চিম দিকে যে পুকুর আছে, সেখানে সারাবছর গাজনের শিব ডোবানো থাকে। গাজন উৎসবের সময় বিজোড় দিনে, সাত, পাঁচ বা তিন দিন আগে শিব ঠাকুরকে জল থেকে তুলে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির শেষে আবার শিব ঠাকুরকে জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। এখানকার মন্দিরের প্রাচীনত্ব দেখেই বোঝা যায় এখানকার গাজনও কত প্রাচীন।
বনগাঁর গাঁড়াপোতায় কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্ক বানেশ্বর শিব লিঙ্গের প্রতিষ্ঠা করেন। এইরকমই জনশ্রুতি আছে। গাঁড়াপোতার এই শিবলিঙ্গ পরবর্তীকালে বাজিতপুরে স্থানান্তরিত হয়। পরে সেখান থেকে সেই শিব অপহৃত হয়। সেই প্রাচীন আমলেই গাঁড়াপোতায় চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজন উৎসবের সূচনা হয়। সেটি নববর্ষ উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
গাঁড়াপোতার এই নববর্ষ উৎসব বাংলার শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। শিব-গৌরীর বিয়ে দিয়ে নববর্ষ উৎসবের সূচনা হয়। সেই সময় মহিষমর্দিনী পূজোয় চালু হয়েছিল পশু বলি দেওয়ার রেওয়াজ। পশু বলি দিতেন গাজনের প্রধান সন্ন্যাসী। এখানেই শাক্ত ও শৈবধর্মের মিলন পাওয়া যায়। আবার গোষ্ঠ বিহারী গোপালের পুজোর প্রচলন করেন বৈষ্ণবরা। গড়ে ওঠে হিন্দুদের তিন ধারার ধর্মের মিলনক্ষেত্র।
বাগদার বাজিতপুরের প্রাচীন শিব মন্দিরে বানেশ্বর শিবলিঙ্গ স্থানান্তর হওয়ার সময় থেকেই সেখানে গাজন উৎসব চালু হয়। সপ্তাহব্যাপী চলে গাজন উৎসবের মেলা। শ্রীনগরের রাজাদের খাদ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত ভান্ডারখোলা থেকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র চলে যাওয়ার সময় তৌজি বন্দোবস্ত দিয়ে যান। সেই সময় রাখাল সেনরা সেখানকার বাসিন্দা ছিলেন। তার পূর্বপুরুষ একটি পুকুর কাটা শুরু করেন। কথিত, মহাদেবের স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুকুর কাটা বন্ধ করে দেন। পাশেই নির্মাণ করেন শিবমন্দির। শুরু হয় শিবরাত্রি ও গাজন উৎসবের।
শ্রীমন্তপুরে ভাদুড়ীদের প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দিরে গাজন উৎসব হয় প্রাচীনকাল থেকেই। মাটিকুমড়ার ঘটক বাড়ির কাছের শিব মন্দিরটি শোনা যায় শশাঙ্কের সময়ে করা হয়েছিল। একসময়ে সেখানে খুব জাঁকজমক করে গাজন উৎসব পালন করা হত। বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার প্রাচীন জোড়া মন্দিরকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষেরা মেতে উঠতেন গাজন উৎসবে। জয়ন্তীপুরের কাছে পিরোজপুরে এবং চাঁদপাড়ায় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে চড়ক মেলা হয়।
বনগাঁয় চড়ক ও গাজনের উদ্যোক্তা প্রথম জমিদার ডেভিড সাহেব। সেই সময় দত্তপাড়া কলঘাটে বসতো চড়কের মেলা। বর্তমানে সেই মেলাই সরে এসেছে চড়কতলায়। এখানে মেলার শুরু করেন হাজারী ঘোষের পূর্বপুরুষেরা। এখন শিমুলতলা এবং জয়পুরেও গাজনের মেলা বসে। এই মেলা খুব বেশি প্রাচীন না হলেও, কমপক্ষে পাঁচদশক সময়কাল অতিক্রম হয়েছে এই মেলার বয়স।
এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে প্রায় বাংলার প্রতিটি গ্রামে চৈত্র মাস জুড়ে চড়ক, গাজনের উন্মাদনা দেখা যায়। বাংলার প্রতিটি গ্রামেই খোঁজ নিলে দেখা যাবে, একটা নির্দিষ্ট খেঁজুরগাছ যা চড়কগাছ নামে পরিচিত। এসবের জন্যই বলা হয়েছে চড়ক, গাজন বাংলার নিজস্ব উৎসব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন