বাংলা নববর্ষ বাঙালির অহংকার
পীযূষ হালদার
বৈশাখ মানেই বাঙালির আবেগ, বৈশাখ মানেই বাঙালির আনন্দ যাপন, বৈশাখ মানেই উৎসব, বৈশাখ মানেই নতুন পোশাক, বৈশাখ মানেই নতুন বছরের নতুন সংকল্প। বাঙালির কাছে বৈশাখ মানেই এক ভালোবাসা। এই বৈশাখী আনন্দ শুরুটা হয় পয়লা বৈশাখ বা ১ বৈশাখ থেকেই। চৈত্র সংক্রান্তিতে নিম-তিতা খেয়ে পয়লা বৈশাখের ভুরিভোজ। কি কি থাকে না সেই খাবারের তালিকায়! মাছ, মাংস, দই, মিষ্টি। এখন যোগ হয়েছে কোলড্রিংস, আইসক্রিম।
শুধুই কি খাওয়া-দাওয়া! ১ বৈশাখ বিশ্বের সমগ্র বাঙালি যেন একাত্মতা অনুভব করেন এই দিনে। পয়লা বৈশাখ কি শুধুই নববর্ষের! বাঙালির গর্বের দিনও বটে। বাঙালির গর্ব এই জন্য, এই দিনটি থেকে শুরু হচ্ছে বাঙালির নিজস্ব একটা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। পৃথিবীতে আর কোনও জাতি আছে, যাদের নিজস্ব এরকম একটা বর্ষপঞ্জি আছে ?
এই দিনে দেশ ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। কিছুটা হেরফের থাকে। প্রতিবেশী বাংলাদেশে নববর্ষ উৎসব পালন করা হয় ১৪ এপ্রিল। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ তো বটেই, তার সঙ্গে ত্রিপুরা, অসম রাজ্যের কিছু অংশে বাংলা নববর্ষ ধুমধাম করে পালিত হয়।
কিন্তু কবে থেকে শুরু হলো বাঙালির এই বর্ষবরণ ? কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন, সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বহুকাল আগে থেকেই সৌর বছরের প্রথমদিন বাংলা, অসম, কেরল, মনিপুর, নেপাল ইত্যাদি ভারতীয় বিভিন্ন প্রদেশে মূলত ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো।
আবার একসময় ঋতুধর্মী উৎসবের সঙ্গে আর্তব উৎসব হিসাবে পালন করা হতো। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির। কারণ, কৃষি ছিল ঋতুনির্ভর। এই কৃষি কাজের সুবিধার জন্যই মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের এই সময়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সৌরসনকে ভিত্তি করেই বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। অনেক ঐতিহাসিক আবার এমনটা মনে করেন না।
কৃষিনির্ভর বাংলায় কৃষির উপর ভিত্তি করে যেমন নববর্ষ পালন করা হতো, তেমনি অসমে এই সময় রঙ্গলি বিহু পালন করা হয়। রঙ্গলি বিহুও কৃষি নির্ভর উৎসব। রঙ্গলি উৎসব চৈত্র সংক্রান্তি থেকে ৬ বৈশাখ পর্যন্ত, সাতদিন ধরে পালন করা হয়। নাচ-গান লোক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালিত হয়।
সম্রাট আকবরের সময় নববর্ষ পালন শুরু হয়। সেই সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার ও অন্যান্য ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এই উপলক্ষে মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পয়লা বৈশাখ আনন্দময় উৎসবে পরিনত হয়ে ওঠে।
এরপর জমিদারদের কাছে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে পুণ্যহের দিন। বনগাঁর জমিদারদের খাজাঞ্চিখানা ছিল দত্তপাড়ায়। সেখানেও পুণ্যহের দিন পালনের ইতিহাস বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যহ উৎসবের বিলুপ্তি ঘটে।
এরপর থেকেই বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব হয়ে ওঠে হালখাতা। এটি পুরোপুরি একটা অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রাম-গঞ্জ-নগরের ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এই উপলক্ষে নতুন-পুরাতন খরিদ্দারদের আমন্ত্রণ করে মিষ্টি বিতরণ করেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসুত্র স্থাপন করেন। চিরাচরিত এই অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। তবুও আগেকার সেই উদ্দীপনা নেই। পয়লা বৈশাখের হালখাতা ব্যাপারটাই এখন ভাগ হয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে পালিত হয়।
কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরানো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটে আবার সংযুক্ত হয়েছে অনেক নতুন উৎসব। কোথাও কোথাও মেয়েরা ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক, লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, খোপায় ফুলের মালা পরে ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবি বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনী গান,- 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো'- গাইতে গাইতে পথ পরিক্রমা করে নতুন বছরকে বরণ করেন।
কোথাও কোথাও সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করা হয়। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়েও দিনটি পালন করেন। সংবাদপত্রগুলিতে নববর্ষের বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। নতুন বছরের শুভেচ্ছাবার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় প্রিয়জনদের কাছে। আগে এসব চিঠিতেই সারা হতো। কয়েক বছর আগেও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে হাজারো রকমের কার্ড পাওয়া যেত। এখন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টাগ্রাম, টুইটার জুড়ে থাকে ডিজিটাল গ্রিটিংস-এর বিনিময়। তবুও বলবো বাঙালির একটি নিজস্ব নববর্ষ আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন