দোল উৎসবের নানা ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে বনগাঁর আনাচে কানাচে
পীযূষ হালদার
দোল-হোলি-বসন্ত উৎসব। ভারতীয় উপমহাদেশে এমনকি পশ্চিম দুনিয়ার কোথাও কোথাও এই উৎসব খুব প্রিয়। দোল রঙের উৎসব। মন আর তনুকে রাঙাবার উৎসব। ভালোবাসার উৎসব। হিন্দু মানুষের কাছে এই উৎসব খুব প্রিয় হলেও বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ধর্মের মানুষরাও এই উৎসব পালন করেন। হিন্দু ধর্মের মানুষেরা রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন ভালোবাসাকে স্মরণ করে এই উৎসব পালন করেন।
পুরানে আছে, প্রহ্লাদকে উদ্ধার করতে অসুর সম্রাট হিরণ্যকশিপুকে ভগবান বিষ্ণু নরসিংহ নারায়ণ রূপে হত্যা করার পর এই উৎসব পালন করা শুরু হয়। আবার কোথাও কোথাও বসন্তকালীন ফসল কাটার উৎসব হিসাবে দোলকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই সমগ্র বাংলা জুড়ে দোল উৎসব পালন করা হয়। বাদবাকি ভারতবর্ষে এই উৎসবকে হোলি বলা হয়। দোলের পরের দিন হোলি পালন করা হয়। সেখানে আগের দিন হোলিকা দহনের মধ্য দিয়ে এই উৎসবের সূচনা হয়।
সাধারণত বসন্তকালীন পূর্ণিমা তিথিতে দোল উৎসব পালন করা হয়। বসন্ত মানে শিমুল-পলাশের রঙে মাতোয়ারা হওয়া। বসন্ত মানে ঝরা পাতার গান। বসন্ত মানে বাতাসে আবিরর সুবাস ছড়িয়ে পড়া। পলাশের মালা বিজয়ের মালা হয়ে গান হয়ে ওঠে। ফাগুন প্রকৃতি তাই নিঃস্ব করে দেয় প্রেমিককে। কেউ কেউ বলেন পূর্ণ করে হৃদয়ের ভান্ডার। জরা-জীর্ণ সব ভেসে যায়, পুড়ে মরে প্রাণের আগুনে।
সময়ের চাহিদা অনুযায়ী রং খেলার, দোলের রকমফের ঘটেছে। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ছাড়া। জলে রং গুলে গায়ে লাগিয়ে দেওয়া এখন কমেছে। সেখানে জায়গা নিয়েছে রংবেরঙের আবির। বাতাসে বহু রঙের সমাহারে বসন্ত প্রকৃতি হয়ে ওঠে রঙিন। আগেকার সেই দোল হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের বা পাড়ার রাস্তায় খোল-করতাল-হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে আবির আর বাতাসে উড়িয়ে আবালবৃদ্ধবনিতাকে রঙ মাখানোর দিন শেষ।
আগে গ্রামবাংলায় দোল মঞ্চ তৈরি করা হতো। সেখানেই পালন করা হতো দোল উৎসব। বনগাঁ মহকুমা গঠনের আগে এই এরকমই কিছু দোলমঞ্চ এবং উৎসবের ইতিহাস আছে। যেমন- গাইঘাটার ইছাপুর এবং গৈপুর। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনও এক সময়ে রাঘোব সিদ্ধান্ত বাগীশ- এর পূর্বপুরুষ গৈপুরে যমুনার তীরে বসতি স্থাপন করেন। পণ্ডিত বংশ। রাজার আনুকূল্যে এখানে সংস্কৃত শিক্ষার টোল-চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করে পুজো এবং শিক্ষাদানের বৃত্তিতে নিয়োজিত হন। তার পর থেকেই এখানে দোল, দেল এবং দুর্গাপুজো শুরু হয়।
ইছাপুরে দোল মঞ্চ তৈরি হয় ১৮২৫ খ্রিঃ। এই মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নন্দরাম ঘোষের সাত পুরুষের আগের এক বংশধর। এই দল মঞ্চের কাছে তৈরি হয়েছিল এক তুলসী মঞ্চ। দোলমঞ্চ দীর্ঘদিন জঙ্গলে পরিপূর্ণ করে থাকলেও পরবর্তীকালে তাকে সংস্কার করে নবরুপ দেওয়া হয়। বর্তমানে এখানেই দোল উৎসব পালন করা হয়। আগে দোলের সময় এখানে মেলা বসতো। চৌধুরী বাড়িতে দোল উৎসব শুরু হলে ঘোষ বাড়ির দোলমঞ্চে শুরু হতো দোল উৎসব। গৌরীপুরে প্রাচীন বসু এবং ঘোষ বাড়িতেও দোল উৎসব খুবই প্রাচীন।
বৈরাম খাঁ-এর নাম অনুসারে গ্রামের নাম বৈরামপুর। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে বৈরামপুর গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন সুরেশ্বর রায়। এই সুরেশ্বর রায়ের প্রোপৌত্র সন্তোষ রায় প্রায় ১০০ বিঘা জমির উপরে বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি শিব মন্দির, রাধাকৃষ্ণের মন্দির, দোলমঞ্চ, দুর্গা মন্দির নির্মাণ করেন। কৃষ্ণ-বলরামের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। রায়দের সেই অতীত গৌরব আর নেই। সেই দোলমঞ্চ আর নেই। তার পাশে বলরাম রায় নতুন করে দোলমঞ্চ তৈরি করে নেন। সেখানে এখনও দোলের দিন সামান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দোলযাত্রা সম্পন্ন হয়।
জমিদারি আমলে ছয়ঘরিয়ায় তৈরি হয়েছিল এক বড় দোলমঞ্চ। সেখানে এক সময় নিয়মিত দোল, পুজো, নামকীর্তন হতো। তখন এখানে দোল অনুষ্ঠিত হতো তিনদিন ধরে। যদিও এখন আর সেখানে দোল উৎসব হয় না। ব্যারাকপুর গ্রামের পশ্চিম সীমানায় দাড়িঘাটা ব্রিজের কাছে এখনও গোস্বামী পরিবারের বংশধরেরা বসবাস করেন।
তার পাশে সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো ভাঙা দোতলা বাড়ির ভগ্নস্তূপ। বর্তমান প্রজন্মের মানুষের ১৮ তম পুর্বপুরুষ ফকিরচাঁদ গোস্বামী, শ্যামসুন্দর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পাশেই তৈরি হয় নাটমন্দির ও দোলমঞ্চ। এখন তা ভগ্নপ্রায়। তবে দোলের দিন এখনও শ্যমসুন্দরের পুজো হয়। গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে কষ্টিপাথরে খোদাই করা শ্যামসুন্দরকে আবির মাখান।
সেই উৎসবে আশপাশের গ্রামের মানুষেরা এসে যোগ দেন। পাটশিমুলিয়ায় এক বহু প্রাচীন দোলমঞ্চ সংস্কার করে বেশ কয়েক বছর ধরে আবার দোল উৎসব পালন করা হচ্ছে। জয়ন্তীপুরে নাওভাঙা নদীর পাড়ে দোলমঞ্চের বয়স কম নয়। সেখানেও প্রতি বছর নিয়মিত দোল পালন করা হয়।
এভাবেই সারা ভারতের সঙ্গে বাংলার মানুষ যেমন দোল বা হোলিতে মেতে ওঠেন, তেমনই বনগাঁ মহকুমার মানুষও এই রঙের উৎসবে মাতেন। এখনকার দোলযাত্রা পালনের প্রাচীনত্বের গৌরবের সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে মহকুমার বিভিন্ন স্থানে, এইসব দোলমঞ্চের মধ্যে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন