সমকালীন প্রতিবেদন : বাবা হেমাত আলি সারাজীবন অন্যের কৃষি জমিতে দিনমজুরের কাজ করেছেন। ঠিকমতো খাওয়া জুটত না। অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা করাতে পারেননি ছেলেকে। সপ্তম শ্রেণিতেই স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় উত্তর ২৪ পরগনার বামনগাছির মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা হাবিবুর মণ্ডলের। সংসারের হাল ধরতে তাঁকেও অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ নিতে হয়। অটো চালানো শিখেছিলেন। যেদিন কাজ মিলত না, সেদিন অটো চালাতেন। এসবে যতটুকু আয় হতো সংসার সামলে চেষ্টা করতেন কিছুটা সঞ্চয়ের।
বরাবরই স্বপ্ন ছিল, নিজের পায়ে দাঁড়ানো। সেই স্বপ্নকেই বাস্তব রূপ দিতে বছরে ২০ হাজার টাকায় সাড়ে তিন বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন। সেই জমিতেই গড়ে তুলেছেন প্রাণী খামার। হাঁস, মুরগি আর ছাগল পালন করে সংসারে অভাব ঘুচেছে। স্কুলে যাচ্ছে দুই ছেলে। বড় ছেলে তৈবুর এবার মাধ্যমিক দিয়েছে। ছোট ছেলে আরশাফুল অষ্টম শ্রেণিতে। খামার দেখাশোনার জন্য আলাদা করে কোনও কর্মী নেই। বাড়ির প্রত্যেকেই নিজের কাজ সামলে সময় দেন খামার পরিচর্যায়।
চারটি ছাগল দিয়ে শুরু করেছিলেন হাবিবুর। এখন তাঁর খামারে তোতাপুরি, যমুনাপারি, শিরহি, বিটেলের মতো নানাজাতের প্রায় ৫০টি ছাগল রয়েছে। কোনওটা দুধ দেয় বেশি। কোনওটার আবার মাংস সুস্বাদু। বেশি বাচ্চা দেয়। ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে এক-একটি ছাগলের দাম ওঠে ৫০-৬০ হাজার টাকা।
ছাগলের পাশাপাশি হোয়াইট পিকিং হাঁস, সোনালী জাতের মুরগিও রয়েছে হাবিবুরের খামারে। আছে টার্কি। এমনকী কালো মুরগি কড়কনাথ। হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফোটানোর জন্য মেশিন বানিয়ে নিয়েছেন। সেই মেশিনে এক-একবারে ৫০০ থেকে ৭০০ বাচ্চা ফোটানো যায়। সেসব বাচ্চা বিক্রিও করেন। এর জন্য তাঁকে কোথাও যেতে হয় না। প্রাণীপালকরা সরাসরি চলে আসেন তাঁর খামারে।
তবে ছাগল পালনের আগেও পরীক্ষামূলকভাবে হোয়াইট পিকিং হাঁস চাষ করেছিলেন হাবিবুর। সালটা ২০১৬। মাত্র ১৩ পিস হাঁস বিক্রি করে বেশ ভালো লাভের মুখ দেখতেই ঝোঁক বাড়ে তাঁর। সফল প্রাণীপালক হিসেবে প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কাছ থেকে পুরষ্কারও পেয়েছেন।
কড়কনাথ মুরগির মাংসের চাহিদা রয়েছে বাজারে। সাধারণ মুরগির তুলনায় এর মাংসের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কড়কনাথ মুরগির মাংসে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। ভালো পরিমাণে রয়েছে আয়রন। ফ্যাট রয়েছে ১.৯৪ শতাংশ। যা সাধারণ মুরগির তুলনায় কম।
পাশাপাশি, অন্য মুরগির মাংসে যেখানে ১৮-২০ শতাংশ প্রোটিন পাওয়া যায়, সেখানে কড়কনাথ মুরগির মাংসে প্রোটিনের মাত্রা ২৫ শতাংশেরও বেশি। এর মাংসে কোলেস্টেরলের মাত্রাও খুবই কম। ০.৭৩ থেকে ১.০৫ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই দাম বেশি হলেও শরীর সুস্থ রাখতে কড়কনাথ মুরগির মাংসের চাহিদা বাড়ছে।
হাবিবুর বললেন, কড়কনাথের দু'দিনের বাচ্চা তিনি বিক্রি করেন প্রতি পিস ৭০ টাকায়। সোনালী প্রজাতির মুরগির বাচ্চার দাম ৩৫-৪০ টাকা। সোনালী আসলে সংকর প্রজাতির মুরগি। রোড আইল্যান্ড রেড ও তাইল্যান্ডের প্রজাতি ফায়ুমি মিলে তৈরি হয়েছে এই নয়া প্রজাতি। নানা রঙের হয়। দেখতে অনেকটা দেশি মুরগির মতো।
তবে এদের ডিম উৎপাদনের ক্ষমতা রোড আইল্যান্ড রেডের থেকে কম। বছরে সর্বোচ্চ ডিম দিতে পারে ১৩০টি। হাবিবুর হোয়াইট পিকিং হাঁসের বাচ্চা বিক্রি করেন ১০০ টাকা পিস। এদের ব্রয়লার ডাক বলা হয়। দ্রুত ওজন বাড়ে। ভিয়েতনাম থেকে এসেছে হাঁসের এই জাতটি। মাংসের জন্যই এই হাঁস প্রতিপালন করা হয়।
কড়কনাথের মতো টার্কিরও অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগব্যাধি থেকে শরীরকে রক্ষা করতে পারে টার্কির মাংস। শান্ত থাকে শরীর ও মন। ঘুম হয় ভালো। নিয়মিত টার্কির মাংস খেলে ফুসফুস, চামড়া, গ্যাস্ট্রিক, কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমতে পারে। বাড়বে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
হাবিবুরের খামার থেকে ১৫০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি হয় টার্কির বাচ্চা। বছরে ছ'মাস টানা ডিম পাড়ে টার্কি। হাঁস-মুরগি, ছাগলের রোগব্যাধি যাতে স্পর্শ করতে না পারে, সেইজন্য ব্লকের প্রাণী চিকিৎসকের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রেখে চলেন এই প্রাণীপালক। নিয়মিত পশুপাখিকে টিকা দেন। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখেন খামার।
ছাগলের খাবার জোগাতে ঘাস চাষ করেছেন হাবিবুর। সকাল হলে খামার থেকে বের করে ছাগল ছেড়ে দেন সেই ঘাসের জমিতে। এছাড়া, খেতে দেন খড়, ভুষি। তাতেই তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে ছাগল। এই প্রাণীপালকের কথায়, ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে বিটেল জাতের ছাগল ১৮০ কেজি পর্যন্ত ওজন হতে পারে। বছরে ওজন হয় প্রায় ৪০ কেজি। মূলত, মাংসের জন্যই এই জাতের ছাগল প্রতিপালন করা হয়ে থাকে।
তোতাপুরি জাতের ছাগলের ওজন হয় ১০০ কেজির মতো। এরা খুব তাড়াতাড়ি পোষ মানে। যমুনাপারি জাতের ছাগল ১২০ কেজি ওজনের হয়। যমুনা নদীর ধারেই এদের আদি বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। সেই সূত্রেই নাম যমুনাপারি। মূলত, দুধ ও মাংসের জন্য ছাগলের এই জাতটি পালন করা হয়।
একটি দেশি গরুর চেয়ে বেশি দুধ দেয় একটি যমুনাপারি। এদের মাথা বড়। কান ঝোলা। একটু লালচে রঙের হয়। শিরহি জাতের ছাগলের ওজন হয় ৮০-৯০ কেজি। হাবিবুরের বার্তা, প্রাণীপালনের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। তবে অল্প করে শুরু করাই ভালো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন