সমকালীন প্রতিবেদন : বাবা আব্দুর রহিম। হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি চাইতেন, ছেলে পড়াশোনা শিখে বড় হয়ে তাঁরই মতো স্কুলে বা কলেজে পড়াক। মা মাসুদা বিবির স্বপ্ন ছিল, ছেলে সরকারি চাকরি করবে। কিন্তু ছোট থেকেই আবুল বাসারের শখ ছিল বাগান করা। বাড়ির উঠোনেই নানা ধরনের ফুলগাছ লাগাতেন। পরম যত্নে বড় করে তুলতেন সেইসব গাছ। ফুল ফুটত। আনন্দে ভরে উঠত বাসারের মন।
উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরের ফলদি গ্রামের বাসিন্দা বাসার হাবড়া শ্রীচৈতন্য কলেজ থেকে কেমিষ্ট্রি অনার্স নিয়ে বিএসসি পাশ করেন। এর পর দিল্লি থেকে এমবিএ করেন মার্কেটিংয়ে। চাকরি নেন একটা ওয়াটার পিউরিফায়ার কোম্পানিতে। তবে মনের কোণে রয়েই গিয়েছিল ছোটবেলার স্বপ্নটা। তাই ওয়াটার পিউরিফায়ার কোম্পানির চাকরি ছেড়ে যোগ দেন কাকার পলিহাউসের ব্যবসায়। জেলায় জেলায় ঘুরতে থাকেন। ধীরে ধীরে আবার মাথাচাড়া দেয় ছোটবেলার নেশাটা।
২০১৬ সালে আইআইটি খড়্গপুর থেকে পলিহাউসের উপরে একমাসের একটি আবাসিক প্রশিক্ষণও নিয়ে ফেলেন। তাতে ঝোঁকটা আরও বাড়ে। ঠিক করেন, নিজেই পলিহাউস বানাবেন। বাসারের বরাবরই অপ্রচলিত চাষের প্রতি আগ্রহ। ফলে ২০১৭ সালে পারিবারিক জমিতে এক হাজার বর্গমিটার পলিহাউস বানিয়ে ঠিক করেন, তাতে জারবেরা চাষ করবেন। ততদিনে তাঁর জানা হয়ে গেছে কোথায় চারা পাওয়া যায়, কীভাবে চাষ করতে হয়।
অতএব, এসবে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয়নি। পুনে থেকে হল্যান্ড ভ্যারাইটির জারবেরার টিস্যু কালচার চারা আনেন। লাল, হলুদ, সাদা, গোলাপি সহ সাতটি রঙের জারবেরার চারা। প্রতিটির দাম পড়ে ৪২-৪৫ টাকা। প্রথম উদ্যোগেই লাভের মুখ দেখেন বাসার। এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রতি বছরই পলিহাউসের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন। ২০১৮ সালে নতুন করে জারবেরার ৭৫০ বর্গ মিটারের আরও একটি পলিহাউস করেন।
২০১৯ সালে ২ হাজার বর্গ মিটার পলিহাউসে চাষ করেন ডাচ গোলাপ। ১৬ হাজার মাদার প্ল্যান্ট এনেছিলেন পুনে থেকে। প্রতি পিসের দাম পড়েছিল ১৫ টাকা। বাসারের পলিহাউসে ঢুঁ মারলেই দেখা যাবে, লাল, হলুদ, সাদা, গোলাপি গোলাপ খেলা করছে। এক-একটি রঙের আবার কত বৈচিত্র্য। সফল এই কৃষক জানালেন, ফুল বিক্রি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি মল্লিকঘাটেই বিক্রি হয়ে যায় সবটা।
তবে তাঁর ফুল অসম, ঝাড়খণ্ডেও যায়। কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে একপিস জারবেরা বিক্রি হয় গড়ে চার টাকায়। একটা গাছ থেকে বছরে প্রায় ৩৫-৪০টি ফুল পাওয়া যায়। গোলাপের যেমন মরশুমে চাহিদা বাড়ে, জারবেরা সারা বছর ধরেই নেওয়া হয়। গোলাপ যখন নেওয়ার দরকার হবে, তার ঠিক দু'মাস আগে থেকে গাছের পরিচর্যা শুরু করতে হয়। পরিচর্যা মানে গাছের ডাল ছাঁটা, ডাল বেঁকানো, খাবারের পরিমাণ বাড়ানো, হরমোন প্রয়োগ।
বাসারের কথায়, স্পেশাল ট্রিটমেন্ট। বাসার বলেন, চাষ মানে চিরাচরিত প্রথায় লাঙল কাঁধে মাঠে যাওয়া, বলদ দিয়ে হাল টানা নয়। চাষকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শিল্প হিসেবেই দেখতে হবে চাষকে। এই কৃষকের কথায়, এক হাজার বর্গ মিটারের একটি পলিহাউস বানাতে দশ লক্ষ টাকা খরচ। এতে অনেক কৃষক পিছিয়ে যান। মনে করেন অনেক খরচ। কিন্তু এটাকে দীর্ঘ মেয়াদি ইনভেস্ট হিসেবে ভাবতে হবে।
প্রথমত, পলিহাউস করার জন্য ন্যাশনাল হর্টিকালচার মিশন থেকে মোট খরচের অর্ধেক সরকারি অনুদান পাওয়া যায়। প্রতিটি জেলাতেই অফিস রয়েছে। ফলে কৃষকরা সেখানে যোগাযোগ করতে পারেন। তাছাড়া, বাকিটা ব্যাঙ্কঋণও পাওয়া যায়। পাঁচ বছরের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিলে খরচটাকে সেভাবে ভাগ করে ফেলতে হবে। দেখা যাবে, বছর হিসেবে খরচ অনেকটাই কমে এসেছে। এছাড়া, একবার পলিহাউস করতে পারলে অন্তত পনেরো বছর থেকে যায়।
এক হাজার বর্গ মিটার পলিহাউস তৈরি এবং তাতে জারবেরা ফুল চাষ করতে হলে প্রথম বছর সবমিলিয়ে খরচ পড়বে ১৬ লক্ষ টাকা। এক হাজার বর্গ মিটার পলিহাউসে ছ'হাজার জারবেরা চারা লাগানো যায়। এর দাম পড়বে ৬ লক্ষ টাকা। একবার চারা লাগালে চার বছর পর্যন্ত সেই গাছ থেকে ফুল পাওয়া যায়। এক হাজার বর্গ মিটার পলিহাউস থেকে বছরে আড়াই লক্ষ জারবেরা পাওয়া যায়। প্রতি পিস চার টাকা দাম হলে বিক্রি করে আসে দশ লক্ষ টাকা।
চাষের অন্যসব খরচ বাদ দিয়েও বছরে চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা লাভ থাকে। বাসারের দাবি, পলিহাউসে চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, প্রাকৃতিক দুর্যোগে গাছ নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে না। রোগপোকার আক্রমণও অনেকটাই কম হয়। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে সহজ হয় অসময়ে ফুল পাওয়া। এক হাজার বর্গ মিটার পলিহাউসে ডাচ গোলাপ চাষ করতে সবমিলিয়ে খরচ সাড়ে ১৪ লক্ষ টাকা।
বাসার জানিয়েছেন, ফুলচাষে এমনিতেই বেশি সার লাগে। পলিহাউসে তিনি তরল সার প্রয়োগ করেন। এতে গাছের খাবার নিতে সুবিধা হয়। ব্যবহার করেন অনুসেচ। এতে একদিকে জলের অপচয় হয় না। আবার গোড়ায় বাড়তি জল জমে গাছ মরে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে না। জলের মধ্যে দিয়েই খাবার দিয়ে দেওয়া যায় গাছকে। শখ থেকে শুরু করা ফুলচাষের মাধ্যমে বাসার এখন লাখপতি।
কাকার অ্যারোটেক ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়াকার্স প্রাইভেট লিমিটেড রয়েছে। এটি মূলত পলিহাউসের ব্যবসা। সেখানে তিনি মার্কেটিং হেড। পাশাপাশি, নিজে নার্সারি খুলেছেন। নাম সারিয়া ফ্লাওয়ার নার্সারি। সেখানে নানা ধরনের ফুল-ফলের গাছ পাওয়া যায়। মেলে ইন্ডোর প্ল্যান্ট। সবমিলিয়ে দশজন তাঁর কাছে কাজ করেন।
করোনাকালীন লকডাউনে ব্যবসায় খানিকটা ছন্দপতন হয়। কিন্তু বসে থাকেননি বাসার। নতুন করে একটা অর্কিডের পলিহাউস করে ফেলেছেন। সেখানে ১২ ধরনের অর্কিডের চাষ হচ্ছে। সবগুলিই থাইল্যান্ড ভ্যারাইটি। তাঁর কথায়, চাষ এখন শুধু লাঙল টানা নয়। চাষ মানে প্রযুক্তির প্রয়োগ। সেটা সঠিকভাবে করতে পারলে যে কোনও কৃষকই লাভের মুখ দেখতে পারবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন