সেকালের দুর্গোৎসব ও সামাজিক বন্ধন
অজয় মজুমদার
সেকালের দুর্গোৎসব ছিল আন্তরিকতায় ভরা। এক অভূতপূর্ব চেতনার সার্থক রূপ। পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল হতো নিজেদের তৈরি ৷ বাড়ি বাড়ি থেকে মায়েদের শাড়ি জোগাড় করে তাই দিয়ে তৈরি হতো প্যান্ডেল ৷ বেশ কিছুদিন আগের থেকে বাঁশ কেটে আনা হতো পাড়া থেকেই। পুজোর ব্যাপারে সবাই ঢালাও বাঁশ কাটার অনুমতি দিতেন। পাড়ার যুবকেরাই সেই প্যান্ডেল সুন্দর করে তৈরি করতেন ৷
তখন ইলেকট্রিক লাইট সেভাবে ছিল না ৷ ডেলাইট কিম্বা হ্যাজাক জ্বালিয়ে পুজো হতো ৷ প্রতিমা তৈরি হতো পাড়ার নিজস্ব জায়গায় ৷ পাল মশাইদেরও বিভিন্ন দিন দেওয়া থাকতো। সারাদিন ধরে প্রতিমা তৈরি করে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরতো। সারাদিনের খাবার জুটত এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে ৷ পুজো কমিটির কর্তৃপক্ষই ঠিক করে দিতো বিভিন্ন বাড়িতে খাবারের।
প্রতিমা তৈরীর বিষয়টি তখন এত আনন্দের ছিল যে, স্কুলের ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেত না ৷ প্রায় সারাদিনই পাল মশাইয়ের কাছে বসে থাকতো ৷ কখন সিংহের চোখে গুলি দেবে, কিম্বা কখন মা দূর্গাকে শাড়ি পরাবে।
মহিষের ওপর কখন মাটি দেওয়া হবে, এইসবই ছিল সেদিনের অনেক বেশি আনন্দের ৷ এইসব দেখতে ছোটরা ব্যস্ত থাকতো ৷ তার মধ্যে ছিল একটা গভীর আনন্দ ৷ পরের দিন স্কুলে গিয়ে অন্যান্যদের সেই ঠাকুর তৈরির গল্প বলতে ওরা ব্যস্ত থাকতো ৷
পুজো শুরু হওয়ার পরদিন থেকে দল বেঁধে প্রতিমা দর্শনে সবাই যেত ৷ রাত নটা, দশটার বেশি কেউ প্যান্ডেলে থাকত না ৷ কারণ রাস্তায় খুব বেশি আলো ছিল না। তবে এটাও ঠিক, ভয়ও ছিল না ৷ পুজোর নতুন পোশাক পরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন মন্ডপ দর্শন করতো। শৈশবের সেই আনন্দ আজ আর নেই ৷
ঢাক বাজানো তখন ছিল একটা শিল্প বিশেষ ৷ মন্ডপে আরতি, নৃত্য, তালে তালে ঢাকের বাজনা ছিল এক অনন্য রূপ ৷ মাইকের যন্ত্রণা ততোটা ছিল না। তখন পুজোর গান ছিল বিখ্যাত। কোন শিল্পী, কোন গান পুজোয় গাইছেন, তার জন্য প্রতীক্ষায় বসে থাকত মানুষ। সেই গানে ছিল এক আবেদন ৷ যেমন, মান্নাদের একটা গান ছিল, পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন, ফিরে আর আসবে কি কখনো, ফিরে আর আসবে কি কখনও ৷
বেতার জগৎ পত্রিকা থেকে এই সমস্ত বিবরণ জানা যেত। বাজি, পটকার খুব চল ছিল। কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না ৷ রাতের বেলায় আরতির পর মণ্ডপ একরকম শুনশান হয়ে যেতো। তবে তখনকার দিনে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আরতি, নৃত্য ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুজোর চার দিন বাইরে থেকে আসা ঠাকুরমশাইরা পাড়ার কোনও বাড়িতে থাকতেন ৷ তাঁরা বেশ পরম যত্নেই থাকতেন ৷ ব্যবস্থা ক্লাব কর্তৃপক্ষই করে দিত।
প্রতি পাড়ার লোক সংখ্যা তখন কম ছিল ৷ পাকা বাড়ির সংখ্যাও কম ছিল ৷ থাকবার জন্য ঘরের সংখ্যা কম ছিল ৷ কিন্তু যেটা ছিল, সেটা হচ্ছে পরম আন্তরিকতা। এই আন্তরিকতা দিয়ে সবকিছু জয় করে নিয়েছিল সেকালের মানুষ ৷ সেখানে পুজোটা ছিল মুখ্য। প্রাচুর্য ছিল গৌণ ৷
বিসর্জনের পরের দিন পাড়ার মধ্যে সমস্ত বয়:জ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রেওয়াজ ছিল ৷ কোনও বাড়িতে হয়তো বাতাসা কিংবা চকলেট কিংবা নারকেলের নাড়ু জুটতো ৷ তাই বলে রসগোল্লা বা মিষ্টির দোকানের অন্য মিষ্টি তখনকার মানুষের খাওয়ানোর ক্ষমতাও সেভাবে কম ছিল। আজকে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বসে থাকলেও তোমার দেখা নাইগো, তোমার দেখা নাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন