রোহিঙ্গা শরনার্থী কেন ? (পর্ব-১৫)
অজয় মজুমদার
রোহিঙ্গা সমস্যা বহুদিনের। মায়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষু আশিন উইরাথুকে রোহিঙ্গা নিধনের নায়ক বলে পরিচিত ৷ ২০০১ সাল থেকে উইরাথু '৯৬' নামে এক জাতীয়বাদী আন্দোলন শুরু করেন। যার কাজ হলো মায়ানমার দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা। এখন প্রশ্ন হলো, মায়ানমার কাদের দ্বারা আক্রান্ত? বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অহিংস চিত্রটা যে পাল্টে যায়– মায়ানমার তার জ্বলন্ত উদাহরণ ৷
স্বাধীনতার আগে পূর্ব ভারত টুকরো টুকরো হয়ে আজকের ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং বার্মা, বর্তমানে মায়ানমার। আজকের বাংলাদেশের এক অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ জীবিকার প্রয়োজনে বার্মায় এসেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তারা আরাকান উপত্যাকায় থেকে যান ৷ রাজনৈতিক বিভাজনে ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ এ বার্মা স্বাধীন হলে তাদের বার্মার নাগরিক হয়ে যাওয়ারই কথা ৷ সেকথা দূরে সরিয়ে রাখলেও বাঙালীদের কিন্তু নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়েছিল, যা ১৯৮২ সালে নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে কেড়ে নেয় সে দেশের সামরিক সরকার। সেই থেকে রোহিঙ্গারা দেশহীন নাগরিক হয়ে উঠল।
অনেকেই বলে থাকেন, রাখাইন সমস্যা ওই দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা। তাতে কার কি বলার আছে ৷ এমন যদি হয়, আপনার বাড়ির পাশে কেউ মদ্যপান ক'রে গোলমাল ক'রে আপনার শান্তি বিঘ্নিত করছে, তাহলে আপনি কি চুপ করে বসে থাকতে পারবেন? আপনি নিশ্চয়ই প্রভাবশালীদের কারও কাছে সমাধানের জন্য বলবেন।
মায়ানমারের অধিকাংশ বৌদ্ধই মুসলমান বিরোধী। এরা মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। এমনকি তারা মুসলমানের দোকান থেকে কোনও জিনিসও কেনেন না ৷ মুসলমানকে বাড়ি ভাড়া দেন না। তাদের কাছ থেকে জমি কেনেন না। তাদের কাছে বিক্রি করেন না। পরিতাপের বিষয় হলো, বৌদ্ধদের অনুমতি ছাড়া সেখানকার মুসলমানরা বিয়ে করতে পারেন না ৷ সামাজিকভাবে বয়কট করে শান্তি হয়নি। প্রয়োজন হলে এই অহিংস বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা ডান্ডা, বন্দুক চালনা করেছেন ৷ এমন দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে ভুরিভুরি রয়েছে ৷
এসবের নায়ক আশিন উইরাথু। উস্কানিমূলক কার্যকলাপ ও ভাষণের জন্য ২০০৩ সালে উইরাথুরের ২৫ বছর জেল হয় ৷ ২০১২ সালে তার মুক্তি হয় ৷ তারপর থেকে তার কাজকর্ম আগের মতোই শুরু হয় ৷ নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ১ জুলাই ২০১৩ টাইম পত্রিকার প্রচ্ছদে উইরাথুর ছবির নিচে লেখা হয় 'বুদ্ধিস্ট টেরর'।
উইরাথু ফাকতা আশি ( Fakta Ashin Wirathu) প্রচারে থাকলেও মায়ানমারের দৈনন্দিন জীবনের দিনলিপিতে রোহিঙ্গা সমস্যার বীজ রোপিত আছে। যে দিনলিপির ছত্রে ছত্রে দরিদ্র, অশিক্ষা, আর অপুষ্টি ৷ বিদ্বেষ, হানাহানিতে প্রতিনিয়ত ইন্ধন যোগাচ্ছে ৷ একদিকে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের দেশে পাঠাতে হবে। আবার বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ঢাকায় জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সারা বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে ৷
ভারত শরণার্থী শিবিরগুলোতে ত্রাণ সামগ্রী পাঠাচ্ছে মিশন ইনসানিয়াত এর মাধ্যমে ৷ প্রাচীন গ্রিসেও আশ্রয়দানের প্রথা দেখা গেছে ৷ বিগত দশকের শেষ পর্বে বহু লেখক, শিল্পী এবং দার্শনিকদের উপর নেমে এসেছিল ফতোয়া এবং রাইফেলের হুমকি। ১৯৯৪ সালে ট্রাসবুর্গ শহরে ধারণাটির প্রয়োগ হলো শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে। ভারতের আদর্শ ধুলোয় লুটোচ্ছে ৷ অমর্ত্য সেন বলেছেন, 'miniaturization of India' ক্ষুদ্র সংকীর্ণ এই ভারতে 'নরদেবতাকে' নমস্কার জানাবার সুযোগ নেই ৷
জেনে বুঝেই প্রতিবেশী দেশগুলির উপযুক্ত ব্যবস্থায় অনীহা ৷ বিশ্ব জনমত জোরালো নয় ৷ আশ্চর্য হতে হয়, ইনক্লুসিভ ডেমোক্রেসির কথা বলে ক্ষমতায় আসা আউং সান সূ-চি নীরব দর্শক ৷ ক্ষুব্ধ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর কর্মীদের অভিযোগ, রাখাইন প্রদেশের ভয়ংকর অবস্থার দিকে না তাকিয়ে সূ-চি ও তাঁর সরকার চুপ করে আছে। তবে কি ধরে নেওয়া হবে, ক্ষমতার মোহ মানবতার উর্দ্ধে? সূ-চি নোবেল পুরস্কারে ভূষিতা। নিজের দেশের উগ্রপন্থাকে যিনি বন্ধ করতে পারেন না, তিনি পৃথিবীর শান্তিকামী বিষয়ে কিভাবে মদত দেবেন? উঠছে সেই প্রশ্ন।
রোহিঙ্গা সমস্যাকে এমপি প্যাথিক্যালি দেখা হোক ৷ তাদের উপর মানবাধিকার ভীষণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে বা হচ্ছে ৷ মানবতার কোনওরকম ব্যবহারই তাদের সঙ্গে করা হয়নি বা হচ্ছে না। সৈন্যবাহিনী যখন যে দেশের মানুষকে অত্যাচার ও ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেশ ছাড়া করছে, তখন কি সেই দেশের নিজস্ব বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত থাকে? রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংগঠনগুলির ভূমিকা এখানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ৷ (সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন