মূর্তি তীরে আট-মূর্তি
সুদীপ কুমার সাহা
পুজোর ছুটির ভিড় এড়িয়ে উত্তরবঙ্গের সুন্দরী ডুয়ার্স কন্যা মনমোহিনী মূর্তির সঙ্গে মাতোয়ারা হতে সাত বন্ধু কলকাতা থেকে চেপে পড়েছি তিস্তা-তোর্ষা এক্সপ্রেসে। রাতের খাওয়া, খোশগল্প আর খুনসুটিতে ট্রেনটিও খোশমেজাজে এগিয়ে চলেছে। রাতে কমলদা মালদা থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে দলে যোগ দেওয়ায় আড্ডাটা অন্য মাত্রা পেল।
ভোর সাড়ে চারটে। নেমে পড়লাম নিউ ময়নাগুড়ি ষ্টেশনে। ষ্টেশনের বাইরে পছন্দসই গাড়ী না মেলায়, খানিকটা হেঁটে বাজারের কাছে এসে গাড়ী ঠিক করলাম। আমরা থাকবো সরকারি বনবাংলো- ‘বনানী’তে। এখান থেকে দূরত্ব প্রায় ২৫ কিমি। শহর ছাড়তেই প্রকৃতি যেন তার রূপ মেলে ধরতে শুরু করল। পাখির কলতান, সোনালী ধানক্ষেত আর সবুজের সমারোহের মাঝে ভোরের প্রথম আলোয় ‘শায়িত বুদ্ধে’র (কাঞ্চনজঙ্ঘার) ঘুম ভাঙানোর দৃশ্য দেখে গাড়ী থামাতে বাধ্য হলাম।
সেই অপরূপ শোভা মন ক্যামেরায় বন্দী করে এগিয়ে চললাম। উঁচু উঁচু বৃক্ষরাজি ঘেরা পথ শুরু হতেই ড্রাইভার এক জায়গায় গাড়ী দাঁড় করিয়ে, জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে প্রণাম সেরে বললেন– এই হল মহাকাল মন্দির। চারদিকে কোনও মন্দির নজরে না আসায় আমরা অবাক হওয়াতে, উনি আমাদের একটা গাছের গোঁড়ায় নিয়ে গেলেন। কতগুলো পাথরের মাঝে ছোট বড় কয়েকটি হাতির মূর্তি– এই তাঁদের বিশ্বাসের মন্দির। বুঝলাম যে, আমরা গজরাজের রাজ্যে প্রবেশ করেছি।
আটটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জঙ্গলে ঘেরা মূর্তি নদীর গা ঘেঁষা ‘বনানী’তে। চেক ইন টাইম দুপুর ১২ টা, তাই ঘর পেতে একটু দেরী হবে। ওয়েটিং রুমে মালপত্তর রেখে বেড়িয়ে পড়লাম। কিছুটা এগিয়ে এলেই একটা ব্রিজ– ছোট জিপগাড়ী যাবার মতো। নদীর এদিকটা গরুমারা জাতীয় উদ্যান, আর ওপারটা চাপরামারি অভয়ারণ্য। খানিক এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর একটি গুমটি দোকান থেকে ঘুগনি-রুটি, চা খেয়ে ফিরে এলাম। ঘর রেডি। ফ্রেস হয়ে নেমে পড়লাম শান্ত মূর্তির শীতল স্বচ্ছ ক্ষীণধারায়। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটু জলে হুটোপাটি করে উঠে এলাম। বর্ষাকালে এই পাহাড়ি নদীগুলোই রুদ্রমূর্তি ধারণ করে।
লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে গ্রামের দিকে গেলাম। অবশ্য কেউ চাইলে জঙ্গল সাফারিতেও যেতে পারেন। এখান থেকে তিনটি সাফারি হয়– চাপরামারি, যাত্রাপ্রসাদ ও চন্দ্রচূড়। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানলাম– রাতের দিকে মাঝে মাঝেই হাতির পাল বেড়িয়ে আসে এই ধান পাকার সময়ে। তাই গ্রামবাসীরা জমির মাঝে ওয়াচ টাওয়ার বানিয়ে রাত পাহারা দেন। এরপর ব্রিজ পেরিয়ে পিচ রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম জঙ্গলের দিকে। বনটিয়া, ময়ূর আরও নানা পাখির ডাক, গাছের ডালে বাঁদরের নাচ দেখতে দেখতে আমরা যে অনেকটা চলে এসেছি, তা স্মরণ করিয়ে সাবধানবাণী দিয়ে গেলেন সাফারি করে ফেরা বনবিভাগের এক গাড়ীর চালক।
সম্বিৎ ফিরতেই সটান ফেরার পথ ধরলাম। ঘন জঙ্গল ছাড়িয়ে ব্রিজটার কাছাকাছি এসে, সকলে রাস্তার উপর বসে পড়লাম। কমলদা আর অমিতদা তাদের দেহের ভারে শুয়েই পড়লেন। ডুবে যাওয়া সূর্যের আভা, পাখিদের ঘরে ফেরার গান, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক যেন আমাদের চুম্বকের মতো আটকে রেখেছে। সেই চুম্বকাকর্ষণ ছাড়িয়ে ব্রিজটার উপর উঠতেই দেখলাম, তখনও কিছু স্থানীয় ছেলেরা মূর্তির জমা জলে মাছ ধরে চলেছে।
পান্থশালায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে পেছনের চাতালে চা-মুড়ি-চানাচুর খেতে খেতে আড্ডা চলল রাতের খাবারের ডাক না পরা পর্যন্ত। মাঝে মাঝেই নদীর ওপারের জঙ্গল থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন বন্য জন্তুর আওয়াজে সকলে নিশ্চুপ হয়ে পড়ছি। কমলদার দুষ্টুমি, রাজার হরবোলা , শুভঙ্করদা–নীহারদা আর নির্ঝরের পশুজ্ঞান-ভান্ডারের উন্মোচনে আমি ও অনিন্দ্যদা হাসির হররা ছুটিয়ে দিচ্ছি। ওদিকে, অমিতদা কিন্তু একমনে শূন্য খবরের কাগজে মাখা মুড়ির দানার সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। দশটার মধ্যে আমাদের রাতের খাওয়া শেষ।
অনেকেই উইকএন্ডে একদিন এখানে ছুটি কাটিয়ে ফিরে যান। আবার অনেকে কাছাকাছির মধ্যে ঝালং, বিন্দু, সামসিং, সান্তালিখোলা ঘুড়ে, বেশ কয়েকটা দিন ডুয়ার্সে ডুবে থাকেন। আমরা অবশ্য আরও একটা দিন মূর্তিতে মজে থাকলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন