সমকালীন প্রতিবেদন : ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার হয়ে মাতা দেবকীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। পুরাণ অনুযায়ী, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্যই জন্ম হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের। জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণের বালক রূপ নাড়ু গোপালের পুজো করা হয়। গোপাল দেবতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যেন আমাদের ঘরের সন্তান। সন্তান হিসেবেই তাঁকে ঘরে পুজো করে থাকি আমরা। গোপাল আসলে সবার আদরের দুলাল। এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যেখানে বাড়ির ছেলের মতোই ঘটা করে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়ে থাকে। তিনি কী খাবেন, কী পরবেন তা নিয়ে চিন্তার যেন শেষ থাকে না। আবার গোপালও বাড়ির ছেলের দায়িত্ব পালন করেন।
গোপালের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের একাত্ম হয়ে ওঠা নিয়ে অনেক গল্পকথা রয়ে গিয়েছে। ভগবানের সঙ্গে সেসব নিবিড় সম্পর্কের কাহিনী যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত। এমনই এক কাহিনী রয়েছে ব্রজের ফলওয়ালি গোপালের মাকে ঘিরে। সে দ্বাপর যুগের কথা। গোকুলে নন্দরাজের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন এক ফলওয়ালি। তাঁর মাথায় ফলের ঝুড়ি। তিনি ফল বিক্রি করতে যাচ্ছেন। হেঁকে হেঁকে ক্রেতা ডাকছেন। তাঁর ঝুড়িতে রয়েছে নানা ধরনের সুমিষ্ট ফল।
দুরন্ত নন্দদুলাল তখন ঘরে একার মনে খেলায় মত্ত। ফলওয়ালির ডাক শুনে দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল তাঁর মাথায়। তিনি দেখলেন, ঘরের মেঝেতে কিছু শস্যদানা ছড়ানো রয়েছে। তিনি দু'হাতে সেই শস্যদানা কুড়িয়ে মুঠো ভর্তি করে বাইরে এলেন। ফলওয়ালি দেখতে পেলেন সেই দেবশিশুকে। দেখামাত্রই মোহিত হয়ে গেলেন তিনি। শিশুটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। গোপাল মধুর কন্ঠে ফলওয়ালিকে বললেন, আমায় ফল দেবে? আমার কাছে একটু শস্যদানা আছে। তার বিনিময়েই তোমার কাছে ফল চাইছি। এই বলে তিনি মুঠো খুললেন। কিন্তু দেখতে পেলেন, মুঠোয় এতটুকু শস্য নেই। সব পড়ে গিয়েছে। এ দেখে গোপালের মুখ ভার হয়ে গেল। করুণ মুখে তিনি ফলওয়ালিকে বললেন, কী করব বলো, সব শস্য মাটিতে পড়ে গিয়েছে। তোমায় দেওয়ার মতো যে আমার আর কিছুই নেই।
ফলওয়ালি মাথা থেকে ফলের ঝুড়ি নামিয়ে রেখে গোপালকে কাছে টেনে নিলেন। প্রাণভরে আদর করলেন। তারপর ঝুড়ি থেকে সবচেয়ে সুমিষ্ট ফলটি তাঁকে খেতে দিলেন। বললেন, এই ফল তো আমার গোপালের জন্যই আনা। তুমি এই ফল খেলে আমি খুব আনন্দ পাব। ফলওয়ালির হাত থেকে গোপাল ফল নিলেন বটে, কিন্তু তার বিনিময়ে তাঁকে কিছু দিতে না পারার আফশোস থেকে গেল গোবর্ধনধারীর মনে। এরই মধ্যে ঘটে গেল এক অলৌলিক ঘটনা। ফলওয়ালি তাঁর ঝুড়ির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলেন। এ কী! একটাও ফল নেই তাঁর ঝুড়িতে। পরিবর্তে রয়েছে রাশি রাশি সোনাদানা। এই কাহিনী উদ্ধৃত করেই বলা হয়, গোপাল এভাবেই ভরিয়ে দেন সবাইকে।
দ্বাপরের সেই গোপাল এলেন কলিতে, শ্রীরামকৃষ্ণরূপে। নবলীলা প্রকাশ করতে। সঙ্গে নিয়ে এলেন আদিপার্ষদদের। তাঁদের মধ্যে ব্রজের সেই ফলওয়ালিকে। শ্রীরামকৃষ্ণ গোপালের মায়ের সম্পর্কে নিজের মুখে বলেছেন, কৃষ্ণাবতারে এই ব্রাহ্মণী ব্রজের ফলওয়ালি ছিলেন। গোপালকে ভালো ভালো ফল খাওয়াতেন। বলা হয়, যমুনা তীরের ফলওয়ালি কলিতে জন্ম নেন গঙ্গাতীরে। কামারহাটির ধর্মপ্রাণ দরিদ্র ব্রাহ্মণ কাশীনাথ ভট্টাচার্যর কন্যা অঘোরমণি হয়ে। আজীবন যাঁর কেটে গিয়েছে গোপালের পুজো করেই। অবশ্য একসময় শ্রীরামকৃষ্ণ ও গোপাল তাঁর কাছে অভিন্ন হয়েই ধরা দেয়। তিনি ঠাকুরকে গোপাল বলেই ডাকতে থাকেন।
আজ জন্মাষ্টমী। এদিন গোপালকে ৫৬ রকম ভোগ নিবেদন করতে হয়। জানেন কেন? এই ৫৬ ভোগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা পৌরাণিক কাহিনী। নিয়ম অনুযায়ী, ৫৬ ভোগের মধ্যে থাকে ১৬ ধরনের জলখাবার, ২০ টি মিষ্টি ও ২০ রকমের শুকনো ফল। যার মধ্যে দুধের তৈরি খাবার সবার আগে পরিবেশন করতে হয়। ননীগোপালের সবচেয়ে প্রিয় হল মাখন আর মিছরি। শ্রীকৃষ্ণ ছোটবেলায় মায়ের আড়ালে ননী খেতেন। তাই তাঁর আর এক নাম ননীগোপাল।
গোপালের পছন্দের খাবারের মধ্যে রয়েছে মালপোয়া। সুজি ও ময়দা দিয়ে তৈরি এই ভাজা মিষ্টি নন্দ উৎসবের ভোগে নিবেদন করা হয়। তালের বড়া আর তালের ক্ষীর তো আছেই। জন্মাষ্টমীর আর একটি উল্লেখযোগ্য ভোগ মোহনভোগ। রয়েছে নারকেল নাড়ু। অনেকে গোপালকে আজকের দিনে বাসন্তী পোলাও রান্না করে খেতে দেন। লুচি–সুজি করে দেওয়া হয়। নিবেদন করা হয় ক্ষীর। যেহেতু গোপাল সবার আদরের, তাই যে যাঁর মতো পছন্দের মিষ্টি খেতে দেন তাঁকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন