সমকালীন প্রতিবেদন : মিষ্টিতে যেন বাংলার একচেটিয়া অধিকার। তা সে রসগোল্লার জন্ম হোক কিংবা সন্দেশের রমরমা। সবেতেই বাংলার কারিগরদের হাতযশ। আর এই মিষ্টিকে ঘিরেই বাঙালির ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মধুর রস। 'আমি বউবাজারের লোক মশাই। তাই মিষ্টিও খাব। ইনসুলিনও নেব'। বাঙালির মিষ্টি প্রীতি নিয়ে বিধান রায়ের এই মন্তব্যই যথেষ্ট। মিষ্টির রকমফের নিয়ে ঘটি-বাঙালের তর্ক-বিতর্কও কম নেই। জানা যায়, মোহিতলাল মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বলতেন, 'তোরা মিষ্টির নাম রাখিস প্রাণহরা। আর আমরা নাম রাখি মনোহরা।'
বাঙালির হাজারো মিষ্টির ভিড়ে উজ্জ্বল শান্তিপুরের নিখুঁতি। বানানভেদে নিখুতি বা নিকুতি। পান্তুয়া গোষ্ঠীর এই মিষ্টি কার ঘরের তৈরি জানেন ? অনেকে বলেন, বোঁদে থেকে নিখুঁতির জন্ম। কিন্তু এই তত্ত্বকে খারিজ করে দিয়েছেন বেশিরভাগ গবেষকই। কলকাতা থেকে ৯৩ কিমি দূর। ট্রেনে আড়াই ঘণ্টার পথ। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভাগীরথী নদী। গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। সন্ন্যাস গ্রহণের পর গঙ্গা পেরিয়ে প্রথম শান্তিপুরেই এসেছিলেন শ্রী চৈতন্য। কারণ, এই শহরেই থাকতেন তাঁর শিক্ষক অদ্বৈত আচার্য। শান্তিপুরের রাসও বিখ্যাত। ইতিহাসের নানা উপকরণ ছড়িয়ে রয়েছে শহরের আনাচে কানাচে। আর তারই সঙ্গে শান্তিপুরের নিখুতির জন্মবৃত্তান্ত ঘিরে রয়েছে এক মজাদার গল্প। যা সমান আকর্ষণীয়।
প্রায় দু'শো বছর আগের কথা। সে সময় খেজুর রস থেকে তৈরি ডেলা চিনির শান্তিপুরে বেশ প্রচলন ছিল। সাহেবদের মুখেও তা দারুণ রুচত। শোনা যায়, জাহাজে চড়ে সেই চিনির ডেলা পাড়ি দিত বিলেতেও। শান্তিপুরের ভো-ভাগাড় মোড়ে ছিল ইন্দ্র ময়রার দোকান। তাঁর আসল নাম ছিল ভোলা। ডেলা চিনি তৈরির বিখ্যাত কারিগরদের পদবী ছিল ইন্দ্র।
ভোলা ময়রার রূপবতী মেয়ে নিখুঁতি। সে প্রায়ই বাবার মিষ্টির দোকানে গিয়ে বসত। একদিন বাবার অনুপস্থিতিতে সে দোকানে বসে খেলার ছলে ছানা আর ময়দার ডেলা পাকিয়ে তেলে ভাজে। বাবাকে আসতে দেখে টকটকে লাল সেই ছানা ভাজা কড়াই থেকে নামিয়ে গামলার রসে ডুবিয়ে দিয়েই পালায় নিখুঁতি। দোকানে ফিরে মেয়ের কীর্তি দেখে রেগে আগুন হন ভোলা। এরই মধ্যে ভোলা ময়রার দোকানে এক খরিদ্দার আসে। তখন দোকানের সব মিষ্টি ফুরিয়ে গিয়েছে। নাছোড় ওই ক্রেতাকে শেষপর্যন্ত আপন খেয়ালে মেয়ের তৈরি করা মিষ্টি দেন ভোলা। সেই মিষ্টির স্বাদে বিভোর হয়ে ক্রেতা পরদিন ফের ভোলার দোকানে আসেন। জানতে চান, আগের দিনের মিষ্টির নাম কী। কানে কম শুনতেন ভোলা ময়রা। তিনি ভাবেন, যে এই মিষ্টি তৈরি করেছে, তার নাম জানতে চাইছেন ক্রেতা। বলেন, নিখুঁতি। উচ্ছ্বসিত ক্রেতা আবার ওই মিষ্টির অর্ডার দেন। ব্যাস, পথ চলা শুরু করে অনন্য নিখুঁতি। বঙ্গবাসী পেয়ে যায় নতুন স্বাদের মিষ্টি। যা আজও শান্তিপুরের গর্ব।
ছানার লেচি ভেজে ফেলা হয় রসে। স্বাদ ও গন্ধ বাড়াতে দেওয়া হয় গোলমরিচ, এলাচ। ল্যাংচার চেয়ে ছোট, আঙুলের মতো দেখতে এই মিষ্টি প্রায় দুই শতাব্দী ধরে বাঙালির জিভের জল ঝরিয়ে চলেছে। তবে সময়ের সঙ্গে নিখুঁতি তৈরির রেসিপি বদলেছে খানিকটা। আগে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা হত। এখন ডালডা দিয়ে ভাজা হয়। মূলত রাতেই বানানো হয় এই মিষ্টি। ৫০০ গ্রাম ছানার সঙ্গে ১০০-১৫০ গ্রাম চিনি মিশিয়ে মাখা হয়। নিখুঁতি তৈরির জন্য আলাদা ডাইস রয়েছে। মোটামুটি নিখুঁতি দুই থেকে আড়াই ইঞ্চির মতো লম্বা হয়। এখন রসে ডোবানোর পাশাপাশি শুকনো নিখুঁতিও পাওয়া যায়।নিখুঁতির জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে একাধিক গবেষণা হয়েছে। এমনকী এখনও গবেষণা চলছে। শান্তিপুরের ইতিহাস খুঁজে বেড়ানো অমিতাভ মিত্রর লেখায় পাওয়া যায়, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়েরও অত্যন্ত পছন্দের ছিল নিখুঁতি। ভোলা ময়রার দোকান বহুকাল আগেই উঠে গিয়েছে। কিন্তু আজও কদর হারায়নি শান্তিপুরের নিখুতি। আসল শব্দটা নিখুঁতি। অর্থাৎ যার কোনও খুঁত নেই। যতগুলিই ভাজুন না কেন, সবক'টিরই আকার একইরকম হবে। গঠনগত দিক থেকে নিখুঁতি পান্তুয়া জাতীয় হলেও আকৃতিতে এটি খানিকটা লম্বাটে। ল্যাংচার মতো। বাইরের দিকটা শক্ত। ভিতরটা নরম।
নিখুঁতির পায়েসও ভীষণ জনপ্রিয়। শান্তিপুর ছাড়াও কৃষ্ণনগর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়াতেও নিখুঁতি মেলে। একসময় কাটোয়ার নিখুঁতি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কিন্তু নিজেদের অধিকার ছাড়তে নারাজ শান্তিপুর। সেখানকার মিষ্টির কারিগরদের বক্তব্য, নিখুঁতি তাঁদের নিজস্ব সম্পদ। এই মিষ্টির জিআই স্বীকৃতি মিলবে না কেন ? নিখুঁতির উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই চলছে তাঁদের। চলছে চিঠিপত্র চালাচালি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন