রবীন্দ্রনাথের ভারতবোধ
স্বপন ঘোষ : রবীন্দ্রনাথ তাঁর মহামানবিক প্রচেষ্টায়, একদিকে ভারতবর্ষের সভ্যতা–সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করেছেন, অন্যদিকে আদর্শ ও জীবনসাধনা দিয়ে আমাদের নিরন্তর অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। তিনি আশা করেছিলেন, সকল সংকীর্ণতা, অশুভবোধ ও আত্মক্ষয় থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত করে এক উচ্চবোধ ও বৃহৎ ঐক্যের মাঝে এসে দাঁড়াতে পারবে। সেই উদারবোধসম্পন্ন ও মঙ্গলব্রতী মানুষই হবে সভ্যতার ধারক। দুঃখের কথা, রবীন্দ্রনাথের মানবিক ধ্যানধারনা, তাঁর শুভ ও মঙ্গলবোধের সঙ্গে আজকের ভারতের যোগাযোগ যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে।
রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছিলেন, ভাবের দিক থেকে ভারতের লক্ষ্য ও সত্য হলো বিশ্বমৈত্রী। তিনি বলেছিলেন, দেশের সম্পূর্ণতা কেবল ভৌমিকতায় নয়, মানবিকতায়। স্বদেশ অর্থে তিনি কেবল নিজের বাসভূমি বোঝেননি, বুঝেছিলেন সমগ্র ভারত, এমনকি সারা পৃথিবীর কথা। এক অবিচ্ছিন্ন ঐক্যবদ্ধ, অখণ্ড ভারতের শুভাশুভ তাঁর চিন্তাকে যেমন অনুপ্রাণিত করেছিল, তেমনই মানবতার আহ্বানকেই তিনি শ্রেষ্ঠ আহ্বান বলে মনে করেছেন। এই মুক্ত মন, মানবিক চেতনা আজ দেশের চিন্তাশীল মানুষের কাছে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নয়ত, ভারতের সব প্রয়াসই ব্যর্থ হবে। রবীন্দ্রনাথের ভারতবোধ এই জন্যই আমাদের কাছে এত প্রাসঙ্গিক। দেশের অখণ্ডতা, মর্যাদা, শক্তি, সাধনা ও ঐক্যবোধ প্রতিষ্ঠায় তাঁর শিক্ষা আমাদের অনুগমণস্থল হতে পারে।
ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে যে দেশটি একদা দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল, আজ সেখানে অভ্যুদয় ঘটেছে নানা ধর্ম, সম্প্রদায়, ভাষা, অঞ্চল, এমনকি গোষ্ঠীকেন্দ্রিক 'sub-nationalism'. নানা ক্ষুদ্র, খণ্ডিত, বিচ্ছিন্নতার কল্পনায় আমরা উন্মত্ত। এই বিপদশঙ্কুল পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা যায় আমাদের ভারতবোধের অপূর্ণতাকে।
অনেক কম বয়সেই কবি ভারতচিন্তা ও স্বদেশপ্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন তাঁর কবিতায় :
'স্বদেশের কাছে দাঁড়ায়ে প্রভাতে
কহিলাম জোড় করে–
এই লহ মাতঃ, এ চির–জীবন
সঁপিনু তোমারি তরে।।'
স্পষ্টতই দেখা যায়, ভারতচিন্তা ও স্বদেশকর্মের আদর্শ কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে একটা সুনির্দিষ্ট রূপ নিয়েছিল। সে সময় তাঁর ভারতবিষয়ক চিন্তা ও কর্মের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা। স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার উপায় হিসাবে তখন রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছিলেন 'স্বাবলম্বন'-এর উপর, আত্মশক্তি সঞ্চারের উপর। সমষ্টিগত স্বাবলম্বন সাধনার জন্য চাই একতা ও সমবায়। রবীন্দ্রনাথ এই একতা ও সমবায় নীতিকে স্বদেশসাধনার অন্যতম অঙ্গ বলে গ্রহণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনই ভারতবর্ষের ইতিহাসের তথা তার সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্বরূপ উদঘাটনে ব্যাপৃত ছিলেন। আত্মশক্তি, রাজা ও প্রজা, সমাজ, স্বদেশ প্রভৃতি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একথাই বলতে চেয়েছেন যে, ভারতীয় সভ্যতার শক্তির মূল উৎস এর রাষ্ট্রশক্তি ও সমাজশক্তির পৃথক সত্তা। সিংহাসন বেহাত হয়েছে, রাজা বদলেছে, কিন্তু সমাজ অক্ষত। এটাই ভারতীয় সভ্যতার মূল শক্তি। তিনি বলেছিলেন, 'ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার প্রাণশক্তি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত। সাধারণের কল্যাণভার যেখানেই পুঞ্জিত হয়, সেইখানেই দেশের মর্মস্থান। সেইখানে আঘাত করিলেই সমস্ত দেশ সাংঘাতিকরূপে আঘাত পায়। বিলাতে রাজশক্তি যদি বিপর্যস্ত হয়, তবে সমস্ত দেশের বিনাশ উপস্থিত হয়। এইজন্যেই ইউরোপে পলিটিক্স এত গুরুতর ব্যাপার। আমাদের দেশে যদি সমাজ পঙ্গু হয়, তবেই যথার্থভাবে দেশের সংকটাবস্থা উপস্থিত হয়। এইজন্যে আমরা এতকাল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ করি নাই, কিন্তু সামাজিক স্বাধীনতা সর্বোতভাবে বাঁচাইয়া আসিয়াছি।' রবীন্দ্রনাথের মতে, ভারতের ধর্মের সাংগঠনিক রূপই হল সামাজিক নিয়ম। তিনি ভারতের সামাজিক স্বাতন্ত্র্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। এই সামাজিক স্বাতন্ত্র্য কি ? রবীন্দ্রনাথের মতে, 'বিলাতে নিঃস্বকে ভিক্ষাদান হইতে সাধারণকে ধর্মশিক্ষাদান, সমস্ত বিষয়েই রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা–আমাদের দেশে ইহা জনসাধারণের ধর্মব্যবস্থার উপরে প্রতিষ্ঠিত।' ভারত সমাজের এই স্বাতন্ত্র্য অবিচল ও অটুট।
ভারতবর্ষের যে ইতিহাস পড়ে ও মুখস্থ করে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা–বৈতরণী পার হয়, রবীন্দ্রনাথ সে ইতিহাসের প্রতি উচ্চারণ করেছেন ধিক্কারবাণী। পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত ইতিহাসকে তিনি বলেছেন, 'নিশীথ রাতের এক দুঃস্বপ্ন কাহিনী।' তাঁর মতে, ভারত–ইতিহাসের মূল শিক্ষা সমন্বয়ধর্মিতা। আর্য, অনার্য, শক, হূণ, মোগল-পাঠানের এক দেহে লীন হয়ে যাওয়া কবি কল্পনা নয়, ইতিহাসসম্মত বাস্তব সত্য। বাইরে থেকে যারা এসেছে, এদের সকলকে সমন্বিত করে সমাজ–বিন্যাস করা, এক সংস্কৃতিজাত মনোবন্ধনে আবদ্ধ করা, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সঞ্চার করা–এই হল ভারতবর্ষের চিরন্তন সমস্যা, আর তার সমাধান প্রচেষ্টাই হল তার জীবনসাধনা। অর্থাৎ ঐক্য ও সমবায়সাধনাই ভারতবর্ষের চিরন্তন সাধনা। বহু বিরুদ্ধের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করতে গিয়ে ভারতবর্ষই আবিষ্কার করল সমস্ত মানুষের অন্তর্নিহিত বিশ্বাত্মাকে। এই বিশ্বাত্মা জড়–অজড়– নির্বিশেষে সমস্ত জগতের মধ্যেই অনুপ্রবিষ্ঠ। এই হল ভারতীয় আধ্যাত্মিক সাধনার শেষ কথা। এরই নাম 'ভারতপথ'।
--------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন