ক্লাবের ১০২তম জন্মদিনে একটি বিশেষ প্রতিবেদন
স্বপন ঘোষ : ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এযাবৎ ইতিহাসকারগণ সকলে একটি বিষয়ে মোটামুটি একমত যে, কলকাতার ফুটবলে তথা ক্রীড়াক্ষেত্রে পূর্ববাংলার খেলোয়াড় সংগঠকদের প্রতি অবহেলা, অবিচার, বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম হয়েছিল।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাব সৃষ্টির মূলে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তিনি ক্লাবের প্রথম যুগের নামজাদা খেলোয়াড় শৈলেশ বসু। ঢাকার বিখ্যাত বসু পরিবারের ছেলে শৈলেশ সুনামের সঙ্গে খেলতেন স্পোর্টিং ইউনিয়নে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদের কারণে পরে চলে আসেন জোড়াবাগান ক্লাবে। কিন্তু চূড়ান্ত ঘটিদের ক্লাব জোড়াবাগানের কর্মকর্তারা বাঙাল হওয়ার কারণে গোড়া থেকেই শৈলেশবাবুকে পছন্দ করতেন না। ১৯১৯-২০ মরসুমে গুরুত্বপূর্ণ খেলার আগে তাঁকে হঠাৎই বাদ দিয়ে দেন। পূর্ববাংলার অন্যতম জমিদার সুরেশ চৌধুরী তখন জোড়াবাগান ক্লাবের সহ সভাপতি। শৈলেশ বাবু বাদ পড়ার বিষয়টি সুরেশবাবুকে জানালে খোঁজখবর শুরু হয়। দেখা যায়, কলকাতার একদল ক্লাবকর্তার আপত্তিতেই বাঙাল শৈলেশবাবুকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রথম ইতিহাসকার রমেশচন্দ্র গোস্বামী (পণ্ডিতমশাই) বা পরবর্তীকালের লেখক সুখরঞ্জন ঘোষ লিখেছেন, এই ঘটনার পরেই সুরেশ চৌধুরী শৈলেশ বসুকে নিয়ে জোড়াবাগান ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। পূর্ববাংলার খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের একত্রিত করে একটা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করাকে তাঁরা আত্মমর্যাদার বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেন। অপমানের যোগ্য জবাব দিতে একটা নতুন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে তাঁরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। শৈলেশ বসুর প্রস্তাবক্রমে ক্লাবের নাম ঠিক হয় 'ইস্টবেঙ্গল'। দিনটি ছিল ১ আগস্ট ১৯২০ ।
নতুন ক্লাবের দল তৈরিতে কোনও অসুবিধা হয়নি। কারণ সেসময় কলকাতায় পূর্ববাংলার খেলোয়াড়দের অভাব ছিল না। ক্লাব প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে এলেন কলকাতায় বসবাসকারী পূর্ববঙ্গীয় অভিজাত সমাজ। মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ, খেলাধুলার জগতের দিকপাল ব্যক্তিত্ব সারদারঞ্জন রায় হলেন ক্লাবের প্রথম সভাপতি। যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হলেন সুরেশচন্দ্র চৌধুরী ও তড়িৎভূষণ রায়। ক্লাবের কর্মসমিতিতে যোগ দিলেন কলকাতার বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত, অভিজাত মানুষ– নন্দলাল রায়, ননীলাল রায়, কেশব গোস্বামী, বনোয়ারীলাল রায়, পঙ্কজ গুপ্ত প্রমুখ।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নামের জাদুতে বাছাই খেলোয়াড় নিয়ে দল গঠনে কোনও সমস্যাই হলো না। তবে সেই সময় লিগে দুটোর বেশি ভারতীয় দল খেলার সুযোগ ছিল না বলে প্রথম সুযোগ পেতে ইস্টবেঙ্গলকে একটু বেগ পেতে হয়। কিন্তু সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর তৎপরতায় আর সাহেবদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগের কারণে ইস্টবেঙ্গল মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই কলকাতার প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ করে নিয়েছিল। এ ব্যাপারে ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাবের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এন. ম্যাকনান সাহেবের অবদান ভোলার নয়। মোহনবাগান, এরিয়ান সহ কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলি হইচই শুরু করলে শেষ পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলকে অন্যায় সুবিধা দেওয়ার অপবাদে ম্যাকনান সাহেবকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তখনকার কুলীন ক্লাব মোহনবাগান বা এরিয়ানের পক্ষে ইস্টবেঙ্গলের এই উত্থানের পথরোধ করা অস্বাভাবিক ছিল না ।
দেখা যাচ্ছে, ইংরেজ রাজত্বে বাংলার ফুটবলকে কেন্দ্র করে লড়াই ১৯২০-র দশকে শুধু আর ভারতীয় বনাম ইংরেজ সমীকরণেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অনেকসময় তা ভারতীয় দলগুলোর দ্বন্দ্বের ইতিহাসকেও তুলে ধরে। আর ভারতীয় দল বা ক্লাব কর্তৃপক্ষের মধ্যেকার এই বিবাদ আসলে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যেকার শক্তিদ্বন্দ্বের বা 'দলাদলির' প্রতিচ্ছবিমাত্র।
তথ্যসূত্র :
১) কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় : 'খেলা যখন ইতিহাস'
২) শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় : 'ক্লাবের নাম ইস্টবেঙ্গল'
৩) জয়ন্ত দত্ত : Glorious Eastbengal'
৪) রমেশচন্দ্র গোস্বামী : 'ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ইতিহাস'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন