কলকাতার জন্ম বৃত্তান্ত
স্বপন ঘোষ
কলকাতার বয়স তিনশো তিরিশ বছর পার হয়েছে। ১৬৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জোব চার্নক সদলবলে এখানে পদার্পণ করেন। অবশ্য অল্প কিছুদিন পরেই এই স্থান ত্যাগ করতে হয় তাঁকে। দ্বিতীয়বারের জন্য জোব চার্নক এলেন ১৬৮৭ সালের নভেম্বরে। সেবারেও বসতি স্থায়ী হল না। অবশেষে ১৬৯০ সালের আগস্টে এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করলেন। এই হিসাবে ১৬৮৬ সাল মতান্তরে ১৬৯০ সালকে কলকাতার জন্ম সময় ধরা হয় এবং জোব চার্নককে বলা হয় কলকাতার জনক।
১) চার্নক এদেশে এলেন ১৬৫৬ সালে। প্রথমে কাশিমবাজারের কুঠিতে কুড়ি পাউন্ডের চাকরি পান। তারপর বলেশ্বর আর হুগলির কিছুদিন কাটিয়ে গেলেন পাটনার সোরা চালানের কুঠিতে। সেখানে ছিলেন একটানা কুড়ি বছর। ১৬৮৬ সালের ১৭ এপ্রিল চার্নক বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট–এর পদ লাভ করলেন। ইতিমধ্যে বাংলায় কোম্পানির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে মুঘল আধিকারিকদের সঙ্গে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। মুঘল সুবাদাররা বিদেশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া হারে শুল্ক দাবি করতে থাকে নানা অছিলায়। পরিস্থিতি সংঘাতের চেহারা নিলে কোম্পানির তরফে চার্নকের কাছে সৈন্য–সামন্ত রাখার ব্যবস্থা করা হয়। চার্নকও ততদিনে বুঝে গেছেন, বাহুবলই আসল মূলধন। চার্নকের বাহিনীর সঙ্গে অতিলোভী মুঘল সুবাদারের বাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ হয়। ১৮৮৬ সালের অক্টোবর মাসে চার্নকের বাহিনী হুগলির মুঘল বাহিনীকে পরাস্ত করল।
২) যুদ্ধে জিতলেও চার্নক হুগলিতে থাকা সমীচীন মনে করলেন না। চলে এলেন সুতানুটি গ্রামে। ১৬৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর কোম্পানির নথিতে লেখা হয়েছিল– 'Left Hughley and went to Chutanuttee'. সুতানুটিতে গুছিয়ে বসার আগেই মুঘলদের ভয়ে তাঁকে চলে যেতে হল হিজলিতে। কিন্তু সেখানেও ব্যবসা জমল না। এদিকে, মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ দেখলেন, বিদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা না করলে অর্থাগম হচ্ছে না। তখন তিনি ইংরেজদের অনুমতি দিলেন সুতানুটিতে বসবাস করার। আবার তল্পিতল্পা নিয়ে চার্নক এলেন সুতানুটিতে ১৬৮৭এর নভেম্বরে। এইসময় কোম্পানির লন্ডনের কোর্ট অব ডিরেক্টরস এর নির্দেশে ক্যাপ্টেন হীথ এলেন কলকাতায়। মুঘলদের সঙ্গে চার্নকের লড়াই কোর্ট অব ডিরেক্টরস ভালো ভাবে নেয়নি, এই বিষয়ে তারা চার্নকের ওপর ক্ষুব্ধ। হীথ সেই ক্ষোভের বার্তা নিয়ে এসেই চার্নককে পাঠিয়ে দিলেন মাদ্রাজ।
৩) এদিকে, বাংলায় ইংরেজ ব্যবসায়ীদের একেবারে বন্ধ হওয়ায় ক্ষুব্ধ ঔরঙ্গজেবের টনক নড়ল। তিনি অতিশয় জ্ঞানী, ন্যায়বান ও সজ্জন ব্যক্তি ইব্রাহিম খাঁকে সুবাদার করলেন। ইব্রাহিম খাঁ'র আমন্ত্রণে জোব চার্নক মাদ্রাজ থেকে সুতানুটিতে তৃতীয় ও শেষবারের মতো এলেন। তারিখটা ২৪ আগস্ট, ১৬৯০। চার্নকের এই শেষবারের আগমনকে কলকাতা সৃষ্টির সূচনা মনে করে ২৪ আগস্ট কলকাতার জন্মদিন পালন করার সাম্প্রতিক একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই হিসাবে একটু গরমিল ধরা পড়ে। প্রথমত, চার্নক এখানে এসে প্রথম বসতি স্থাপন করেন ১৬৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। দ্বিতীয়ত, চার্নকের দল যেখানে এসে ওঠেন, সেই জায়গাটার নাম সুতানুটি, কলকাতা নয়। তৃতীয়ত, সুতানুটির দক্ষিণে কলকাতা গ্রামের অনুন্নত অস্তিত্ব ছিল চার্নকের আগমনের শতাধিক বছর আগে থেকেই।
আবুল ফজলের আইন–ই–আকবরীতে কলকাতার উল্লেখ রয়েছে। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে :
'ত্বরায় চলিল তরী তিলেক না রয়
চিৎপুর সালিখা এড়াইয়া যায়।
কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা
বেতড়েতে উত্তরিল অবসান বেলা'।
১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে জনৈক ওলন্দাজ Van den Broucke এর মানচিত্রে Collecatta এবং Calcuta এই দুটি স্থানের নাম পাওয়া যায়। স্থান দুটি প্রায় সন্নিহিত এবং Soetanatte এর কিছুটা দক্ষিণে অবস্থিত। ভ্যান ডেন ব্রোকের মানচিত্র নির্ভুল সেকথা বলা চলে না। তবে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার অস্তিত্বের কথা অনস্বীকার্য।
৪) উক্ত স্বাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে বলা চলে কলকাতার জন্ম তারিখ ১৬৮৬ অথবা ১৬৯০ হতে পারে না। তবে ইংরেজদের তৈরি কলকাতাকেই যদি আদত কলকাতা বলে ধরা হয় এবং গ্রাম কলকাতাকে যদি একেবারেই উহ্য রাখা হয়, তাহলে অন্য কথা। কিন্তু সেক্ষেত্রেও হিসেবটা একটু ঘষে মেজে দেখা দরকার। জোব চার্নকের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক একেবারে ছিল না বললেই চলে। তাঁর পছন্দ ছিল সুতানুটি গ্রাম। কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিরা সুতানুটিতেই ফ্যাক্টরি বা কুঠি নির্মানের অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সুতানুটিতেই গুছিয়ে বসার অল্পদিন পরেই চার্নকের মৃত্য হয় (১০ জানুয়ারি ১৬৯৩)।
যদি চার্নক আর দুচার বছর আয়ু পেতেন, তাহলে সুতানুটিতেই পাকা কুঠির পত্তন হত। অতএব পরবর্তী কালে সুতানুটির সঙ্গে আশেপাশের গ্রামগুলি সংযুক্ত হলেও বর্ধিত শহরের নাম সুতানুটিই হত, কোনমতেই কলকাতা হত না। মাদ্রাজ ও লন্ডনের সমস্ত কাগজপত্রে কলকাতার নামোল্লেখও নেই। সুতানুটিকেই বাংলার প্রধান কর্মকেন্দ্র বলা হয়েছে। চার্নকের পরবর্তী কর্মকর্তারা সুতানুটি ছেড়ে কলকাতায় উঠে এলেন বলেই কোম্পানির কাগজপত্রে সুতানুটির নাম লেখা বন্ধ হল। শুরু হয়ে গেল কলকাতার নাম লেখা।
কলকাতার স্থান নির্বাচন এবং শহর পত্তনের ষোলআনা কৃতিত্ব যাঁর, তাঁর নাম জন গোল্ডসবরা। তিনি ছিলেন কোম্পানির কমিশরি জেনারেল এবং সমস্ত কুঠির চিফ গভর্নর । গোল্ডসবরা সুতানুটিতে এসে তার অগোছালো চেহারা দেখে বিরক্ত হয়ে কোম্পানির কুঠিকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন। কুঠি তৈরির জন্য কলকাতা গ্রামের গঙ্গার ধার ঘেঁষে একটা জায়গা তাঁর পছন্দ হল। সেখানেই তৈরি হল প্রথম ফোর্ট উইলিয়াম। উত্তরে এখনকার ফেয়ারলি প্লেস, দক্ষিণে কয়লাঘাটা স্ট্রীট, পূর্বে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু রোড আর পশ্চিমে স্ট্র্যান্ড রোড– এই চৌহদ্দির মধ্যেই ছিল সেকালের ফোর্ট উইলিয়াম এবং সেই কেল্লারই আশেপাশে জনবসতি বাড়তে বাড়তে শহর কলকাতার সৃষ্টি হয়। এই বিচারে শহর কলকাতার জন্ম সাল ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দ এবং তার পত্তনীকার স্যার জন গোল্ডসবরা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন