সমকালীন প্রতিবেদন : সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী সিনেমা 'পথের পাঁচালি'। কিন্তু ছবিটি তৈরির সময় খুবই আর্থিক সঙ্কটে ছিলেন পরিচালক। এতটাই অভাব যে, এই প্রোজেক্ট থামিয়ে দেওয়ার কথাও ভাবেন একসময়। সত্যজিতের স্বপ্নভঙ্গের সেই মুহুর্তে এগিয়ে আসেন কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমার। ছবির কাজ শেষ করার জন্য ৫ হাজার টাকা ধার দেন সত্যজিৎ রায়কে।
কিশোর কুমারকে নিয়ে বায়োপিক তৈরি করতে চলেছেন পরিচালক সুজিত সরকার। এই কাজের জন্য তথ্য ঘাঁটতে গিয়েই সুজিত জানতে পেরেছেন, একের পর এক অজানা কাহিনী। কিশোর কুমারকে নিয়ে বায়োপিক বানানোর কাজে কোনও ফাঁক রাখতে চান না পরিচালক। জোরকদমে শুরু করে দিয়েছেন গবেষণা।
সম্প্রতি সুজিত শেষ করেছেন ‘সর্দার উধম সিং’-এর কাজ। সর্দার উধম সিং ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। জালিওয়ানাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন ভিকি কৌশল। এবার তিনি তাঁর ছবির বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছেন কিশোর কুমারকে। তাঁকে নিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করছেন পরিচালক। যত পড়ছেন, যত জানছেন, ততই সব উঠে আসছে নানা অজানা তথ্য। এই অজানা-অচেনা কিশোর কুমারকেই তিনি তাঁর ছবিতে তুলে ধরতে চান।
সুজিত জানিয়েছেন, প্রথম ছবি বানাতে গিয়ে প্রচণ্ড অর্থকষ্টের মধ্যে পড়েছিলেন সত্যজিৎ। নিজের জীবন বিমা বেচে দিয়েছিলেন। স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখেছিলেন। কিন্তু এসব কথা তিনি কাউকে বলতেন না। কিশোর কুমারের পরিবার নানা রকম তথ্য দিয়ে সাহায্য করছে তাঁকে। তবে পরিচালক জানিয়েছেন, কিশোর কুমারকে জানতে তিনি একবার লতা মঙ্গেশকর এবং আশা ভোঁসলের কাছেও যাবেন। যদিও সেলুলয়েডে কিশোর কুমারের চরিত্রে তিনি কাকে ভাবছেন, তা নিয়ে এখনই কিছু বলতে চান না।
জানা যায়, শেষমেশ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সাহায্যে ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির আলো দেখে। এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সমস্যা থাকায় ছবি তৈরির কাজ ব্যাহত হয় এবং দীর্ঘ তিন বছর পরে তা সম্পূর্ণ হয়। স্বল্প নির্মাণব্যয়ে অপেশাদার অভিনেতা ও অনভিজ্ঞ শিল্পীদের নিয়ে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সেতার বাদক রবিশঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ ব্যবহার করে চলচ্চিত্রের সঙ্গীতাবহ সৃষ্টি করেন। সুব্রত মিত্র চিত্রগ্রহণ ও দুলাল দত্ত সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ৩ মে নিউ ইয়র্ক শহরের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের একটি প্রদর্শনীতে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। পরে সেই বছর কলকাতা শহরে মুক্তি পেলে দর্শকদের প্রশংসা লাভ করে। সমালোচকরা চলচ্চিত্রটিতে প্রদর্শিত বাস্তবতাবাদ, মানবতা ও গুণমানকে প্রশংসা করলেও অনেকে এর মন্থর লয়কে চলচ্চিত্রটির খামতি বলে মনে করেন।
পথের পাঁচালী ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সামাজিক বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে সমান্তরাল চলচ্চিত্রের ধারা তৈরি করে। স্বাধীন ভারতে নির্মিত পথের পাঁচালী ছিল প্রথম চলচ্চিত্র, যা আন্তর্জাতিক মনোযোগ টানতে সক্ষম হয়। এটি ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার লাভ করে। যার হাত ধরে সত্যজিৎ রায় ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে একজন বলে গণ্য হন। এছাড়াও এই চলচ্চিত্রটিকে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় দেখা যায়। ১৯৮৭ সালে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কিশোর কুমার। তার পর কেটে গিয়েছে ৩৪ টা বছর। কিন্তু, এখনও তিনি 'জীবিত', ভক্তদের মনে।
গায়ক–অভিনেতা কিশোর কুমার তো সবার পরিচিত। এর পাশাপাশি সংগীতকার, নির্মাতা, পরিচালক, লেখক কি না ছিলেন তিনি ! এই কিংবদন্তির কালজয়ী একের পর এক গানের সঙ্গে রয়েছে জীবনভরের এমন অনেক কাহিনি যা সকলকে অভিভূত করবে। সত্যজিৎ রায়ের 'চারুলতা' ছবিতে একটি গানের রেকর্ড করে কোনও পারিশ্রমিক নেননি কিশোর কুমার। সত্যজিৎ রায় যখন তাঁকে ফি–এর কথা জানতে চান, তখন তিনি তাঁকে প্রণাম করেছিলেন।নিজের কেরিয়ারের অধিকাংশ সময়টাই রাজেশ খান্না, জিতেন্দ্র, দেব আনন্দ ও অমিতাভ বচ্চনের ছবির জন্য গান গেয়েছেন কিশোর কুমার। 'খাইকে পান বাণারসওয়ালা', কালজয়ী এই গানের কথা তো সবার জানা। শোনা যায়, গানটির রিয়েল অনুভূতি আনতে বারাণসী পান চিবোতে চিবোতে সমানে মেঝেতে থুতু ফেলে গিয়েছিলেন গায়ক। রাজেশ খান্নার জন্য কিশোর এত গান গেয়েছেন যে, অভিনেতা বলতেন, 'আমরা এক গলায় দুই ব্যক্তি।'
কিশোর কুমারের দাদা অশোক কুমার একজন কিংবদন্তি অভিনেতা ছিলেন। কিশোরের শৈশব অবস্থাতেই বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বড় স্টার হয়ে ওঠেন অশোক। ১৯৪৬ সালে 'শিকারি' ছবিতে অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ কিশোরের। গানে অভিষেক হয় ১৯৪৮-এর 'জিদ্দি' ছবি দিয়ে। অশোক কুমার চাইতেন কিশোর তাঁর মতোই বড় অভিনেতা হোক। কিন্তু, কিশোরের তো মন পড়ে থাকত গানে।
১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে ২২ টি ছবিতে অভিনয় করেন কিশোর। যার মধ্যে অবশ্য ১৬ টি ছিল ফ্লপ। পরিচালক ও নির্মাতারাও হতাশ হয়ে পড়েন। সেই সময় আর ডি বর্মন তাঁকে স্টাইল পাল্টে ফেলার পরামর্শ দেন। মার্কিন গায়ক জিমি রজার্স ও টেক্স মর্টনের স্টাইল রপ্ত করেন কিশোর। গানকে কিশোর কুমার এতটাই ভালোবাসতেন যে, কলেজের কড়া শিক্ষকরাও তাঁকে অনুৎসাহিত করতেন না। ক্লাসরুমে তিনি বেঞ্চে তবলা বাজাতেন। একবার এক শিক্ষক বিরক্ত হয়ে তাঁকে তা থামাতে বলেন। সেই সময় কিশোর তাঁকে জানিয়েছিলেন, গান গেয়েই তিনি জীবন নির্বাহ করতে চান। সেটাই হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন