তালিবানি আগ্রাসনের নেপথ্যে
স্বপন ঘোষ
ভারতের উত্তর–পশ্চিম দিকে, পাকিস্তানের পশ্চিমে, পুরোপুরি সমুদ্রবর্জিত, পার্বত্যময় দেশ আফগানিস্তান। এখন ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের কোনও সীমান্তসংযোগ নেই। ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হলে এবং কাশ্মীরের এক–তৃতীয়াংশ আজাদ–কাশ্মীর নামে পাকিস্তানের দখলে চলে যাবার পর আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের ভৌগলিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেছিলেন খ্রিষ্ট পূর্ব ৩২৭ অব্দে। তারও আগে পারস্য সম্রাট দারায়াস আফগানিস্তানের পথেই ভারতে আক্রমণ চালিয়ে ছিলেন। ব্যাকট্রিয় গ্রীক আর কুষাণরা ভারত ও ভারতের বাইরে একসঙ্গে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম ও ধর্মকেন্দ্রীক স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের অসংখ্য নিদর্শন এখনও ছড়িয়ে আছে আফগানিস্তানে। এদেশে মুসলিম শাসনের গোড়া থেকেই এই সংযোগ আরও প্রসারিত হয়। আলাউদ্দিন খলজির মতো মুসলিম শাসকদদের একটা বড় অংশই ছিল আফগান। বাবর তো ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় আফগানিস্তানে রাজত্ব করেছিলেন। আমজনতার কাছে অবশ্য এইসব তথ্যের খুব বেশি মূল্য নেই। তাঁরা আফগানিস্তান মানেই বোঝেন কাবুল। আর কাবুল মানেই কাবুলিওয়ালা ! রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা , তপন সিংহ–ছবি বিশ্বাসের সেই সিনেমা : কাবুলিওয়ালা আর মিনি। বিদেশ–বিভুইয়ে পড়ে থাকা মানুষের এক কিশোরী কন্যার প্রতি অপত্য স্নেহের বহিঃপ্রকাশ– যা মানবিকতার সৌধ হয়ে আমাদের মনে প্রতিষ্ঠিত।
না, সেই কাবুলিওয়ালার দেশ আর নেই। শান্ত, নিরীহ, পরিশ্রমী আফগানিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের হাড় হিম করা সন্ত্রাসের আতুড়ঘর আগলেছেন। দীর্ঘকাল আফগানিস্তান ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তারক্ষেত্রের অধীন। আমেরিকা এটা মেনে নিতে পারেনি। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের চরিত্র অনুযায়ী, দুই মেরুর দুই শক্তিধর রাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধ না করে পরস্পরের অধিকৃত অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সদা তৎপর থেকেছে। আমেরিকা সোভিয়েত–প্রভাবিত আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করতেই আফগানি উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে একসময় ধারাবাহিকভাবে মদত দিয়ে এসেছে। মোটা অংকের সামরিক সাহায্য দিয়েছে। পপি ফুলের স্বর্গরাজ্য হিন্দুকুশ আর সোয়াট উপত্যকা পোস্ত চাষের পাশাপাশি আফিম আর হেরোইন তৈরির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন সব জেনেও চোখ বন্ধ করে থেকেছে। এই অশুভ আঁতাতেরই অনিবার্য পরিণতি ওসামা বিন লাদেনের মত ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের উত্থান।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসান ঘটল। আফগানিস্তান থেকেও সোভিয়েত–প্রভাব দূর হল। কিন্ত ততদিনে গোটা আফগানিস্তান মৌলবাদ আর সন্ত্রাসবাদের আখড়ায় পর্যবসিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে মৌলবাদী তালিবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করল। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এই পাঁচ বছরের তালিবানি শাসনকাল বর্বরতার সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। সবধরণের ধর্মীয় গোঁড়ামী, মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার, বিচারের নামে প্রকাশ্য হত্যা, বৌদ্ধ ও অন্য ধর্মের প্রাচীন সৌধ ও ভাস্কর্যগুলিকে ধ্বংসসাধন– সব চলেছিল নির্বিচারে। গান্ধার শিল্পের নিদর্শন, পৃথিবীর বৃহত্তম বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তিগুলোকে তালিবানিরা এইসময়েই ধ্বংস করে।
আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের অবসান ঘটাতে ২০০১ সালে জাতিপুঞ্জের ব্যানারে মার্কিন–ফরাসি ন্যাটো বাহিনী লাগাতার সামরিক অভিযান চালায়। ২০০১ সালে এই তালিবান শাসনের অবসান হল আফগানিস্তানে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের প্রতি আফগানি মৌলবাদী শক্তির ক্রোধ ও ঘৃণা তীব্র প্রতিহিংসায় পরিণত হয়। এই প্রতিহিংসারই পরিণতি ওসামা বিন লাদেনের উত্থান এবং ৯/১১ তে (২০০১) টুইন টাওয়ারের পতন। লাদেনকে ধরার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর এক দশক ব্যাপী সামরিক আস্ফালন আফগানিস্তানকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। তালিবান শক্তি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মার্কিন আক্রমণে শেষপর্যন্ত ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের আটোবাবাদ থেকে মার্কিন বাহিনী লাদেনকে ধ্বংস করে।
লাদেনের মৃত্যু হল। তালিবান শাসনের অবসান ঘটল। মার্কিন প্রশাসনের মদতে সামরিক প্রশাসন শুরু হল আফগানিস্তানে। লাদেনের মৃত্যুর পর থেকে আফগানিস্তানে কয়েকটি প্রবণতা লক্ষ্যনীয় : ১) প্রশাসনিক পুনর্বাসনের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত খবরদারি, ২) তালিবানরা কোণঠাসা হলেও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি। আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলের নানা গোপন আস্তানায় তারা শক্তি সঞ্চয় করছিল। ৩) গনি প্রশাসনের অপদার্থতায় আফগানিস্তানে ক্ষোভের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত একদশক ধরে আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে আসার পর বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গুমরে থাকা ক্ষুব্ধ তালিবানিরা এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে তৎপর হয়েছে। তারা জানে, মার্কিন সাহায্য ছাড়া গনি প্রশাসন অত্যন্ত দুর্বল। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। গত প্রায় তিনমাস ধরে আফগানিস্তানে যে পালাবদল শুরু হয়েছে, তাকে এই প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে। ক্ষুব্ধ, উন্মত্ত, ধর্মোন্মাদ, অপেক্ষাতাড়িত তালিবানরা এখন ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে নিশ্চিতভাবে এগোচ্ছে।
মৌলবাদ ও মৌলবাদী কার্যক্রমের কোনও শ্রেণীকরণ হয় না। শ্রেণী, জাত, ধর্মগত ভেদাভেদের ঊর্ধে তার একটাই পরিচয়, তা অন্য ধর্মের প্রতি, বোধসম্পন্ন মানুষের প্রতি, নারীদের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতি কখনোই সহনশীল নয়। গোঁড়ামীর শেষবিন্দু পর্যন্ত পৌছে তা কেবল মানবতাকেই আঘাত করে। যেমন এখন তালিবানিরা শুরু করেছে আফগানিস্তানে। গত কয়েক বছরের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে আমরাও কি তার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন