Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

সোমবার, ১৯ জুলাই, ২০২১

ঘরে বাইরে লড়াইয়ে টোটোদের দিনবদল

 

ঘরে বাইরে লড়াইয়ে টোটোদের দিনবদল

সমকালীন প্রতিবেদন : ‌আজও মোরগের ডাকে সকাল হয়। ডেকে ওঠে ময়ুরের দল। পাহাড় থেকে সরু পাইপ বেয়ে পড়ছে জল। সেটাই পানীয়। ঘুঘু ডাকা নির্জন দুপুর। পড়ন্ত বিকেলে ঘিরে ধরে জংলি পোকার শব্দ। কোলের শিশুকে কাপড়ের টুকরোয় বেঁধে অরণ্য পথে ঘরে ফেরেন টোটো-মা। মাথায় জ্বালানি কাঠের বোঝা। ঘড় ঘড় শব্দে পাথুরে রাস্তায় হেলতে দুলতে ধুলো উড়িয়ে এসে থামে দিনের শেষ ট্রেকার। একে একে নামেন যাত্রীরা। নামে মালপত্র, ছাগল, মুরগি। পাহাড়ের বুকে যেন চুল এলিয়ে বসেছে অস্তরাগ। নির্জনতা ভেদ করে প্রকট হচ্ছে পাখিদের ঘরে ফেরার কূজন। জঙ্গলের মধ্যে উঁকি দেয় এক টুকরো আঁধার, যেন আদিম নিশান। বিস্তীর্ণ নদীখাত জুড়ে তখন শুধুই শূণ্যতা। কানের পাশ দিয়ে বয়ে যায় খড়ি ওঠা হাওয়া। নিশ্চুপ দাঁডিয়ে ভুটান পাহাড়। নিঝুম সন্ধ্যা নামে তার কোলে। জোৎস্না রাতে জমে ওঠে আড্ডা। গিটার বাজিয়ে গান ধরেন সনি টোটো। ঢোলে বোল তুলে গলা মেলান অভিষেক টোটো। কবিতায় আর নাচে-গানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় নদী-পাহাড়-উপত্যকা। বাঁশের মাচায় তখন অনেকেই হাড়িয়ার নেশায় বুঁদ। 

ঘরে বাইরে লড়াইয়ে টোটোদের দিনবদল

আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট থেকে বাউরি ২২ কিলোমিটার। বাংরি, তিতি, পূর্ণিখোলা, কালীখোলা, ডয়ামারা পেরনোর পর বাউরি। একের পর এক পাহাড়ি নদী পেরিয়ে পাথুরে পথ ধরতেই ডানা মেলে টোটোদের জগৎ। ঘরে বাইরে লড়াই। একদিকে, নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। অন্যদিকে, সমাজ ও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রয়াস। আর এই দুইয়ের মাঝে পড়েই পাহাড়ি ছোট্ট জনপদে কখনও গুমরে মরছে জাত্যাভিমান, কখনও আবার বিপন্নতাকে জয় করে এগিয়ে চলার শপথ নিচ্ছেন আদিম জনজাতির মানুষগুলো। শহুরে কোলাহল আর আলোর রোশনাইয়ে ভেসে যাওয়া রাজপথ থেকে অনেক দূরে নীরবে নিভৃতে বদলে যাচ্ছে টোটোদের নিজস্ব পৃথিবী। এ এক অন্য দিনবদলের গল্প। একসময় জল-জঙ্গল আর প্রকৃতির মাঝেই যাঁদের কেটে যেত দিন-রাত, তাঁদের হাতেই আজ স্মার্ট ফোন। হাত বাড়ালেই কম্পিউটার, ইন্টারনেট। কু-সংস্কারের বেড়াজালে একদিন যাঁদের বাঁধা ছিল জন্ম থেকে মৃত্যু, শিক্ষার আলোয় আজ তাঁদের ছেলেমেয়েরাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। রক্ষণশীলতা ভেঙে এই একবিংশ শতকে সমাজের মূলস্রোতে শামিল হওয়ার চেষ্টায় আদিম জনজাতির টোটোরা। 

ধুমসি গাঁও, পূজা গাঁও ঘুরে মিত্রং গাঁওয়ে পা রাখতেই থমকে দাঁড়াতে হয়। বাঁশের খুঁটির উপর খড়ের দোচালা বাড়ির সামনে। অপূর্ব কারুকার্য। গোটা গ্রামে এই একটিই। আর একটি টিকে আছে সুব্বা গাঁওয়ে। কিন্তু সেটাই বা কতদিন। টোটো পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা ধনিরাম টোটোর কথার সূত্র ধরে মনের কোণে উঁকি দেয় প্রশ্নটা। আগে খয়ের কাঠ দিয়ে বাসগৃহ বানাতেন টোটোরা। সেসব ঘর নির্মাণে নিজস্বতা ছিল। ঘরের মধ্যে পুজো, খাওয়া-দাওয়া, শোওয়া এমনকী অতিথি আপ্যায়নের জন্য নির্দিষ্ট ছিল জায়গা। আলাদা আলাদা নাম ছিল সেসবের। এখন সরকার পাকা বাড়ি বানিয়ে দিচ্ছে। সবমিলিয়ে সাড়ে তিনশো পরিবারের মধ্যে কয়েকটি বাঁশ আর কাঠের ঘর টিকে আছে। কিছুটা বেড়ে এখন মোট জনসংখ্যা ১৬০০-র মতো।

মিত্রং গাঁওয়ে বাজার লাইনে কুপির আলোয় হাট বসেছে। চলছে বিকিকিনি। পাশেই বিউটি পার্লার। নেপালি মহিলা অপূর্ব লামার স্ত্রী সেটি চালান। বিয়েবাড়িতে মাইকে বাজছে নেপালি গান। ভুটান থেকে কাজ সেরে ফিরছিলেন চার যুবক। তাঁদের সঙ্গে দেখা সীমানাদাঁড়ায়। একজনের জামার পকেটে থাকা মোবাইলের রিং টোনে বেজে ওঠে জনপ্রিয় হিন্দি গানের কলি। একসময় পশুপালন আর ঝুমচাষ ছিল টোটোদের প্রধান জীবিকা। এখন ওঁরা ভুট্টা ফলান। গ্রাম জুড়ে রয়েছে সুপারি বাগান। স্কোয়াশ, শাক-সবজি চাষ করেন। অনেক বাড়িতেই বাইক। কেউ কেউ গ্যাসে রান্না করছেন। পুরনোকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় না নতুন প্রজন্ম। কাজের সূত্রে তাঁরা পাড়ি দিয়েছেন বাইরে। কেউ সিকিম, কেরল, কেউবা ভুটানে। ৪০ জন টোটো সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করছেন। এম এ পাশ ছেলেও রয়েছে টোটোপাড়ায়। কয়েকজন কলকাতায় চাকরির পরীক্ষার কোচিং নিয়েছেন। কয়েকজন ছেলেমেয়ে পড়ছে দার্জিলিংয়ে। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার জন্য টোটোপাড়ায় রয়েছে ধনপতি মেমোরিয়াল স্কুল। এছাড়া চলছে দু'টি ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুল। গ্রামের একপ্রান্তে নির্জনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। 

টোটো মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্নাতক রীতা টোটো। অনগ্রসর শ্রেণিকল্যান দপ্তরে চাকরি পেয়েছেন। ছেলেদের মধ্যে প্রথম স্নাতক সঞ্জীব টোটো। প্রথম অনার্স স্নাতক সঞ্চিতা টোটো। প্রথম স্নাতকোত্তর ধনঞ্জয় টোটো। তাঁর বিষয় লাইব্রেরি সায়েন্স। আক্ষেপ, এখনও চাকরিটা পেলেন না। ধনিরাম টোটো বলছিলেন, দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় টোটোদের মধ্যে শিক্ষাচিত্রের একটা পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, কিন্তু রয়ে গিয়েছে বাধা। মাঝপথে টোটো ছেলেমেয়েদের অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে। কারণ, একদিকে আর্থিক সঙ্কট। অন্যদিকে চাকরি পাওয়ার অনিশ্চয়তা। সহজে উপার্জনের জন্য বেশিরভাগই বেছে নিচ্ছেন ভুটানে পাথর ভাঙার কাজ। তবে দিনবদলের আবহে হারিয়ে যাচ্ছে টোটোদের নিজস্ব সংস্কৃতি। দখল নিচ্ছে মিশ্র সংস্কৃতি। টোটোপাড়ায় এখন ভুটানি, ধীমাল, নেপালি, রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষজনের বাস। 

বিলুপ্তপ্রায় টোটোদের নিজস্ব ভাষা ইয়োওয়া। টোটোদের নিজস্ব লোকগান বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসও সেভাবে চোখে পড়ছে না। যদিও সবটাই যে হারিয়ে যাচ্ছে, তা মানতে নারাজ বকুল টোটো, সত্যজিৎ টোটোরা। তাঁদের কথায়, হারিয়ে যেতে বসা গানকে নতুন রূপে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে। টোটোদের গ্রামের খবর তুলে ধরতে নিজস্ব ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকা। ভবেশ টোটোর স্নাতক মেয়ে শান্তি টোটো বলছিলেন, 'আমি বাংলা মাধ্যমেই পড়াশোনা করেছি। তবে মাতৃভাষা ভুলিনি। স্বপ্ন দেখি, আমাদের সমাজ থেকে কেউ ডাক্তার হবেন, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার।'‌ পথের ধারে স্মার্টফোনে ফেসবুকে মশগুল শুভ্রা টোটোর ছোট্ট সংযোজন, 'দেখবেন আমাদের গ্রাম একদিন হয়ে উঠবে সিটি ভিলেজ।' শুনে খানিকটা ধাক্কা লাগলেও ফিরতি পথে গ্রামের মানুষগুলোর চাহনিও যেন সেকথা‌ই বুঝিয়ে দিচ্ছিল বারবার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন