এক অন্তহীন মৃত্যু
শুভঙ্কর সাহা
ফাদার স্ট্যান স্বামী মারা গেলেন। বলা ভাল, তাকে তিলে তিলে মারা হলো। চুরাশি বছর বয়সে। আমাদের দেশে আরও এক বন্দির মৃত্যু ঘটলো। এরকমটা আকছার হয়, কি এ রাজ্যে, কি অন্য রাজ্যে। বিচারাধীন বন্দির মৃত্যু আমাদের দেশে কোনো নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু সংশয় জাগে, আমরা কি এখনো পরাধীন? যেসব আইন ইংরেজরা তৈরি করেছিল এদেশের বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্য, সেই একই আইন স্বাধীন দেশে বহাল তবিয়তে বহাল। খটকা লাগে সেখানেই। সংবিধান প্রত্যেকটা মানুষের বেঁচে থাকার যে অধিকার দিয়েছে, এমনকি প্রত্যেকটা বন্দির যে সুচিকিৎসার বা চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারের কথা বলেছে, তা আমাদের রাষ্ট্রের আচরণে মাঝেমাঝে বিস্মৃত হই।
একজন চুরাশি বছর বয়সের মানুষ রাষ্ট্রের কাছে এতটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন যে, বারবার জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করা হয় ? তিনি পারকিনসন্স রোগে ভুগছিলেন। চশমা খুলে নিলে তিনি প্রায় অন্ধ। শক্ত খাবার খেতে পারেন না। খাবার পেস্ট করে সিপার দিয়ে তাঁকে খেতে হয়। অথচ একজন ব্যক্তির এই সমস্ত ন্যূনতম চাহিদার কিছুই মাথায় রাখলো না আমাদের রাষ্ট্র। খাবারের অভাবে দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়লেন তিনি। জেলে থাকতেই কোভিড আক্রান্ত হলেন। এসব কিছুই এনআইএ- কে টলাতে পারেনি। ফলে জামিন নামঞ্জুর। ফাদার এর বিরুদ্ধে কেন এরকম হলো ? আসলে তিনি এক অসম যুদ্ধে নেমেছিলেন।
আদিবাসী, দলিত মানুষদের লড়াই-সংগ্রামে তিনি যত নিজেকে জড়িয়েছেন, ততই তিনি হয়ে উঠেছেন দিনে দিনে রাষ্ট্রের কাছে বিপজ্জনক। তিনি কিন্তু বেশি কিছু চান নি, অন্যায় কোনও দাবিও করেন নি। সংবিধান স্বীকৃত যে অধিকারটুকু আছে, সেটুকুই শুধু ফেরত চেয়েছেন। জল জঙ্গল মাটির অধিকার। তাই রাষ্ট্রও তাঁকে দেখেছে বারেবারে প্রতিপক্ষ হিসেবে, মানুষ হিসেবে না। আসলে শাসক কখনোই চায় না তার চোখে চোখ রেখে কেউ কথা বলুক, কেউ প্রশ্ন তুলুক। তাই দেশের প্রতিটি কোনায় যে বা যারা এরকম মত প্রকাশ করেন, তাঁরা রাষ্ট্রের চোখে হয়ে ওঠেন দেশদ্রোহী। ফাদারের মৃত্যু আমাদের রাষ্ট্রের এই কাঠামোকে আরও বেআব্রু করে দিয়ে গেল। আমরা আবারও বুঝতে পারলাম এক দেশ হিসাবে, জাতি হিসাবে আমাদের এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন