সমকালীন প্রতিবেদন : দার্জিলিংয়ে এসে পৌঁছেছেন নিবেদিতা। উঠেছেন লেবং কার্ট রোডে। রায় ভিলায় বসু দম্পতির কাছে। বাড়িটি অবলাদেবীর বড় বোন সরলাদেবী ও ভগ্নিপতি দ্বারকানাথ রায়ের। প্রথম কয়েকদিন সবাই মিলে আনন্দে কাটল। জগদীশচন্দ্র সান্দাকফু যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। রাজি হয়ে গেলেন নিবেদিতা। বললেন, 'ওখানে একটি মঠ আছে। দেখব।' চিঠিতে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এস কে রেডক্লিপকে জানালেন সেকথা। সান্দাকফু যাওয়ার জন্য ঘোড়ায় জিন কষা হল। বিছানা বাঁধা হয়েছে। সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাবার-দাবার তৈরি। হঠাৎই ক্লান্ত বোধ করতে লাগলেন ভগিনী। ঠিক হল, যাত্রা কয়েকদিন পিছিয়ে দেওয়া হবে। আগে নিবেদিতার শরীর ঠিক হোক। কিন্তু ক্রমেই অসুস্থতা বাড়তে লাগল। ভগিনীর প্রচন্ড জ্বর, সঙ্গে রক্ত আমাশয়। চিকিৎসক নীলরতন সরকার তখন দার্জিলিংয়ে। তাঁকে খবর দেওয়া হল। তিনি এলেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল চিকিৎসা। কিন্তু ডাক্তারবাবু হয়তো বুঝতে পারছিলেন, এই লড়াই জেতা সম্ভব নয়। নিবেদিতার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন বসু দম্পতি। তাঁরা ঠিক করলেন, নিবেদিতাকে কলকাতায় নিয়ে যাবেন। নিষেধ করলেন চিকিৎসক। বললেন, 'এত দূরের যাত্রা। শরীরে ধকল হয়তো সহ্য হবে না।' ফলে রায় ভিলাতেই চিকিৎসা চলতে লাগল।
দিনটা ৩ অক্টোবর, ১৯১১। রোগশয্যা থেকেই বোন উইলসনকে চিঠি লিখলেন ভগিনী। সময় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু তখনও দৃপ্ত ব্যক্তিত্বশালীনি তিনি। কেউ তাঁর ঘরে এলে স্মিত হাসিতে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। সহজে নিজের কষ্টের কথা, অসুখের কথা, বলতে চান না। বরং তাঁর মুখে শোনা যায়, আরও কাজের পরিকল্পনা। বলেন, বাগবাজারের স্কুলের কথা। ৭ অক্টোবর। নিবেদিতার নির্দেশে উকিল ডাকা হল। তৈরি হল উইল। নিজের যা কিছু সঞ্চিত অর্থ, গ্রন্থস্বত্ব থেকে আয়, চিরস্থায়ী তহবিল হিসেবে তুলে দিলেন তাঁর স্কুলকে। লক্ষ্য, নারী শিক্ষার প্রসার। তহবিলের অর্থ থাকল বেলুড় মঠের ট্রাস্টির তত্ত্বাবধানে। উইলে শর্ত যোগ করলেন ভগিনী। বিদেশি শাসকদের সঙ্গে এই বিদ্যালয়ের কোনও সম্পর্ক থাকবে না। এবং তাদের কাছ থেকে বিদ্যালয়ের জন্য কোনও সাহায্য নেওয়া হবে না। নিবেদিতা যেন নিজের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। এবার তিনি চলে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। একেকটি দিন কাটছে। অবলাদেবীকে ভগিনী বলছেন, আমার শেষ সময় উপস্থিত। আর তা শুনেই বসু দম্পতির আশ্বাস, চিন্তা কোরো না। সুস্থ হয়ে উঠবে। এই অসুখ মোটেই মারাত্মক নয়। কিন্তু মনে মনে তাঁরাও প্রমাদ গুনছিলেন। নিবেদিতা যা পড়তে বা শুনতে ভালোবাসেন, তা পড়ে শোনাচ্ছেন জগদীশচন্দ্র।
শেষ সন্ধ্যায় রায় ভিলায় পাঠ চলছিল। অসুস্থ ভগিনীর আবেগতাড়িত মন আলোড়িত হতে পারে ভেবে জগদীশচন্দ্র সেদিন কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে পড়েন। কিন্তু মৃত্যুশয্যাতেও নিবেদিতার মস্তিষ্ক পুরোমাত্রায় সজাগ। বিষয়টি ধরে ফেললেন তিনি। ফলে জগদীশচন্দ্রকে পুরোটা পড়তে হল। দার্জিলিঙে আসার কয়েক মাস আগেই প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মের একটি প্রার্থনা বাণী ইংরেজিতে অনুবাদ করেন নিবেদিতা। এমনকী সেটি ছেপে পরিচিতদের মধ্যে বিলি করেন। নিবেদিতার অনুরোধে সেই প্রার্থনা বাণীটি আবৃত্তি করে শোনান অবলাদেবী। আবৃত্তি শেষ হলে নিবেদিতা উচ্চারণ করেন উপনিষদের দিব্যবাণী। অমনি দীপ্ত হয়ে ওঠে তাঁর মুখমন্ডল। অবলাদেবী বারবার জিজ্ঞাসা করায় ক্ষীণ কন্ঠে নিবেদিতা জানান, 'বড্ড ক্লান্ত লাগছে।' তারপর অস্ফুট স্বরে স্বগতোক্তি করে বলেন, 'নৌকা ডুবছে। আমি কিন্তু সূর্যোদয় দেখব।' সেই রাতে তাঁকে খাওয়ানো গেল না। ওষুধও খেলেন না। সরিয়ে দিলেন অক্সিজেনের নলটা। তিনি যেন চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
১৩ অক্টোবর, শুক্রবার। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাতটা। কারও মুখে কোনও কথা নেই। গত কয়েকদিন ধরে দার্জিলিংয়ের আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। কিন্তু আজ সকালটা বড় সুন্দর। ঝকঝকে সোনা রোদ গায়ে মেখে চিকচিক করছে চিরতুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা। জানালা দিয়ে একফালি রোদ প্রবেশ করল তাঁর ঘরে। রবি রশ্মির সেই মধুর স্পর্শ অসুস্থ নিবেদিতার বিষন্ন মনে আনন্দের সাড়া জাগাল। আর তারপর তিনি চোখ বুঝলেন। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে (১৮৬৭-১৯১১)।
নিবেদিতার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। পুজোর ছুটিতে অনেকেই পাহাড়ে বেড়াতে এসেছিলেন। খবর পাওয়া মাত্র ছুটে এলেন সবাই। রায় ভিলার সামনে উপচে পড়ল ভিড়। বেলা দু'টোর সময় শুরু হল শেষযাত্রা। হাজার হাজার মানুষ সামিল হয়েছেন। শ্মশানভূমিতে পৌঁছতে বেজে গেল বিকেল চারটে। সবাই নতমস্তকে। রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথ শেষ সময়ে এসে পৌঁছেছিলেন। তিনি মুখাগ্নি ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। যে বাড়িতে নিবেদিতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সেটি আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে দার্জিলিংয়ে। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বাড়িটি সংরক্ষিত হয়েছে। দেখভালের জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে। ঐতিহাসিক এই বাড়িটির জীবনকথা রোমাঞ্চকর। বহু ঘটনার সাক্ষী। সে শুধু রায় ভিলা কেন, দার্জিলিং শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ভগিনীর কাজকর্মের নানা নিদর্শন। দার্জিলিংয়ের মাটিতে মিশে আছে নিবেদিতার চিতাভস্ম। দার্জিলিং স্টেশন থেকে একটু নীচেই জায়গাটির নাম মুর্দাহাটি। এখানেই শ্মশান। প্রখ্যাত লেখক তথা ভাষাবিদ রাহুল সংকৃত্যায়নের সমাধি রয়েছে এখানে। তার পাশেই নিবেদিতার স্মৃতিসৌধ।জানা যায়, নিবেদিতার চিতাভস্ম চার ভাগ করা হয়। একভাগ রাখা হয় দার্জিলিংয়ে। একভাগ পাঠানো হয় বেলুড়ে। এক ভাগ যায় বোস ইনস্টিটিউটে। আর আরেক ভাগ নিবেদিতার জন্মস্থান আয়ারল্যান্ডে। তবে প্রয়াণের শতবর্ষ পার করে এসে ভগিনীর সমাধিক্ষেত্র তথা স্মৃতিসৌধ আজ অনেকটাই অনাদরে। বদলে যাওয়া পাহাড়ে গুমরে কাঁদছে ইতিহাস। আক্ষেপ শুধু এটুকুই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন